যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লঞ্চ সার্ভিস। যে সার্ভিসে ভর করে ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে রাজধানীতে যাতায়াত করেছে বরিশালসহ দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ। তার বিদায় ঘণ্টা বাজছে এবং সেই নমুনাও মিলেছে এরই মধ্যে। ক্রমাগত লোকসান সামাল দিতে না পেরে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল লঞ্চ এমভি কীর্তনখোলা-১।
শুরুতে আস্ত লঞ্চ বিক্রির চেষ্টা করেছিল মালিক পক্ষ। ব্যবসা নেই বুঝে কিনতে রাজি হননি কেউ। শেষ পর্যন্ত কেটে কেটে চলছে লোহার দরে বিক্রি। কেবল কীর্তনখোলাই নয়, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী আরও অন্তত সাতটি লঞ্চ এভাবে কেটে বিক্রি করছেন মালিকরা। লঞ্চ মালিকরা জানান, ‘আর তো কোনো উপায় নেই। যে কটি লঞ্চ চলছে তাও লোকসান দিয়ে। প্রতিবার রাউন্ড ট্রিপে যদি দেড় থেকে দু’লাখ টাকা লোকসান হয় তো কতদিন টিকবে মালিক?’
পদ্মা সেতু চালু হলে লঞ্চযাত্রায় ভাটা পড়বে এমন আশঙ্কা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই আশঙ্কা যে এতটা ভয়াবহ হবে তা হয়তো বুঝতে পারেননি কেউ। সেতু চালু হওয়ার দিন থেকেই শতকরা ৫০ ভাগ যাত্রী হারায় লঞ্চ। তবু কোনো না কোনোভাবে চলছিল টিকে থাকার চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টায়ও মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি।
মালিকরা জানান, ‘তেলের দাম বাড়ার আগে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে আমাদের খরচ হতো ছয় লাখ ২০ হাজার টাকা। দাম বৃদ্ধির পর সেটি গিয়ে আট লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রী কমলেও টিকেছিলাম আমরা। লোকসানের মাত্রা খুব একটা বেশি ছিল না। এক ট্রিপে লোকসান হলে অন্য ট্রিপে পুষিয়ে যেত। কিন্তু তেলের দাম বৃদ্ধির পর চোখে অন্ধকার দেখছি। সরকারি রেটের তুলনায় ভাড়া কম নেওয়া হচ্ছে ডেকে। কেবিনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় প্রায় অর্ধেক নিচ্ছি আমরা। তার পরও যাত্রী উঠছেন না লঞ্চে।’
মালিকরা আরও জানান একেকটি লঞ্চে গড়ে কেবিন রয়েছে প্রায় ৪০০। ধারণক্ষমতা প্রতিটি লঞ্চের কমবেশি এক হাজার। যাত্রী সংকটের কারণে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে রোটেশন পদ্ধতি। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলের অনুমতি রয়েছে ১৮টি লঞ্চের। সেখানে এখন উভয়প্রান্ত থেকে তিনটি করে মোট ছয়টি লঞ্চ চালাচ্ছি আমরা। ভেবেছিলাম এতে করে সংকটের কিছুটা হলেও সামাধান হবে। কিন্তু তা হয়নি। রোববার বরিশাল থেকে তিনটি লঞ্চে যাত্রী এসেছে মাত্র এক হাজার ৬০০। অথচ এই তিন লঞ্চের ধারণক্ষমতা সাড়ে তিন হাজার। সব লঞ্চে অর্ধেকের বেশি কেবিন খালি ছিল। ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোরও ছিল একই অবস্থা। এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তো আর লঞ্চ চালানো যাবে না। প্রতি রাউন্ড ট্রিপে দুই-তিন লাখ টাকা লোকসান দিতে হলে তো জমি বাড়ি বিক্রি করতে হবে।’
কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, ‘হয়তো দুই-তিনটি লঞ্চ থাকবে। তাও না থাকার মতো। এ ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই সেক্টরটি বন্ধ হয়ে গেলে কয়েক হাজার মানুষ বেকার হবে। শ্রমিক কর্মচারী মিলিয়ে একেকটি লঞ্চে কর্মী আছে ২৫-৩০ জন করে। সেই সঙ্গে ঘাটে কাজ করা লোকজন। লঞ্চ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও কাজ হারাবে। মালিকদের কথা ভাবুন। ২০-২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একেকটি লঞ্চ তৈরি হয়েছে। এই শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী? প্রত্যেক লঞ্চ মালিকের ব্যাংক ঋণ রয়েছে। নিয়মিত কিস্তি দিতে হয়। কিভাবে দেবে তারা?