সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সওজ অধিদপ্তরের আলোচিত এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, ভুয়া বিল উত্তোলন এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ থাকলেও অদৃশ্য কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। বিগত আওয়ামী শাসনামলে সওজ প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানের অনিয়ম-দুর্নীতি, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়।
সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তার চালচলন, কাজকর্ম ছিল রাজনৈতিক নেতাদের মতো। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নাকে এমপি বানানোর স্বপ্নও ছিল তার। সেই লক্ষ্যে স্ত্রীকে দিয়ে একটি অনিবন্ধিত এনজিও পরিচালনা করাতেন; যার কাজ ছিল মূলত সবুজ উদ্দিন খানের কালো টাকা সাদা করা। সবুজ উদ্দিন খানের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।
সূত্র জানায়, ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি ৬ তলা বিলাসবহুল বাড়ি, বসুন্ধরা সিটিতে ৪টি দোকানসহ ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে নাম-বেনামে সবুজ উদ্দিন খানের সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের নামেও বিভিন্ন জায়গায় জমি, বাড়ি এবং বাণিজ্যিক সম্পত্তি কেনা হয়েছে, যা সাধারণ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোন কোন সূত্র বলছে বিদেশ পড়ুয়া সন্তানের মাধ্যমে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছে মালয়েশিয়া ও কানাডায়। করছে টাকা পাচার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়িটির মালিক সবুজ উদ্দিন খান নিজেই। বাড়িটির নকশাও তার নামে। যদিও প্লটটির মালিকানায় দেওয়া তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্না, শ্যালিকা নুরজাহান আক্তার ও নারগিস আক্তার হীরার নামও। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিলাসবহুল বাড়িটিতে সবুজ উদ্দিন নিজে অবস্থান খুব কম করেন, সেখানে তার স্ত্রী শ্যালিকা এবং শ্যালিকার স্বামী বসবাস করেন। আর তিনি থাকেন রাজধানীর গুলশানের বাড়িতে।
সবুজ উদ্দিন খানে গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার আমিনপুর এলাকায়। সেখানে তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্না সিনথি চ্যারিটি ফাউন্ডেশন নামে একটি অনিবন্ধিত এনজিও পরিচালনা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার দপ্তরের সহকর্মীরাই বলেন, উল্লিখিত মানবকল্যাণ সংগঠনটির নামে বিভিন্ন কারসাজি দেখিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন ধুরন্ধর এই প্রকৌশলী। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের সুবিধা দিয়ে ফাউন্ডেশনটিতে চাঁদাও আদায় করতেন সবুজ উদ্দিন খান। দুর্নীতির টাকা স্থানীয় বিশ্বস্ত কিছু অনুসারীর কাছেও রেখেছেন সবুজ ও তার স্ত্রী।
সবুজ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে সিনথি ফাউন্ডেশন ও পরিবারের নামে জমি দখলসহ নানা অভিযোগ করেছেন আমিনপুরের বাসিন্দারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢালারচর ইউনিয়নের মীরপুর চরে ১০০ বিঘা জমি রয়েছে সবুজ পরিবারের। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নার নামে জাতসাখিনী ইউনিয়নের নান্দিয়ারা গ্রামে রয়েছে ৩০ বিঘা জমি, গাজনার বিলেও মাহমুদার নামে অন্তত ৫০ বিঘা জমি রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সবুজ উদ্দিন খানের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান, আমিনপুর থানার মাসুন্দিয়া ইউনিয়নের সবুজের গ্রামের ডুপ্লেক্স বাড়ি ২০ বিঘা জমির ওপর। যার বর্তমান মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা। একই গ্রামে সিনথি পাঠশালা নামে ৫০ বিঘা জমির ওপর মাঠসহ স্কুল ও গরুর ফার্ম করেছেন স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্না। স্থানীয়দের অভিযোগ, এর মধ্যে অন্তত ৪০ বিঘা জমিই জবরদখল করেছেন তারা। শ্যামপুর গ্রামের আক্কাস, মজিদ প্রাং, সনতেষ মণ্ডলসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ, জমি বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় মাস্তান বাহিনী দিয়ে তাদের জমি দখলে নিয়েছেন সবুজ ও মাহমুদা। এ ছাড়া শ্যামপুর, চর শ্যামপুর, দয়ালনগর, আমিরাবাদ, মালঞ্চি, বাদাই, শাতালী, তালিমনগর, চিনাখড়া ও কাশিনাথপুর-নান্দিয়ারা গ্রামে নামে-বেনামে ২০০ বিঘা জমি আছে।
সবুজ উদ্দিন খানের ওই আত্মীয় আরও বলেন, ‘সবুজ যেন এক টাকার মেশিন। অবৈধ আয় লুকাতে ঘুষের টাকায় স্ত্রীকে দিয়ে সমাজসেবার নাটক করতেন তিনি। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নাকে পাবনা-২ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি বানানোরও স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। ভয়ে আমরা কিছুই বলতে পারিনি। তারা যে পরিমাণ লুটপাট করেছেন, আমরা পরিবারের সদস্য হয়েও লজ্জিত। আমরা তাদের শাস্তি চাই।’
প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ: ঢাকা-আরিচা মহাসড়কসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রকল্পগুলোর উন্নয়নকাজে সবুজ উদ্দিন খান সরকারের তহবিল থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই মহাসড়ক উন্নয়নে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় দেখিয়ে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে জানা গেছে, সড়কটি ৩৫ ফুট চওড়া করার নামে মাটি ভরাটের খাতে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাস্তবে মাত্র ২০ কোটি টাকার মাটি ব্যবহার করা হয়। অনেক স্থানে ঠিকাদারদের সহায়তায় ভুয়া বিল উত্তোলন করে সরকারের বিপুল অর্থ লোপাটের কৌশল নিয়েছেন তিনি।
এছাড়া, ঠিকাদারদের সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করিয়ে প্রকল্পের মান নষ্ট করেছেন। অভিযোগ অনুসারে, সড়কে ৭০% পাথর ও ৩০% বালির পরিবর্তে ৪০% পাথর ও ৬০% বালি ব্যবহার করেছেন, যা সড়কের স্থায়িত্ব ও গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সড়কের ফুটওভার ব্রিজ, বাস স্ট্যান্ড ইত্যাদি অংশেও নিম্নমানের ইট, বালু ও পাথর ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির কৌশল চালানো হয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক সুবিধা আদায়: অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে থেকেই ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার করেছেন সবুজ উদ্দিন খান। সাভারে সড়ক বিভাগের স্ট্যাক ইয়ার্ডে প্রায় ৩ একর জমিতে তিনি সরকারি মালামাল সংরক্ষণ না করে আবিদ মনসুর নামের একজন ঠিকাদারকে হট মিক্সার প্ল্যান্ট স্থাপনে সহায়তা করেছেন। এভাবে প্রায় ৭০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকারকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এই আবিদ মনসুর নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটান এবং নানা সুবিধা আদায় করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে ঘুরেফিরে সড়ক বিভাগের মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা এই তিন কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন সবুজ উদ্দিন খান। টানা ৮ বছর দায়িত্বে ছিলেন অধিদপ্তরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে। তার বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অলিখিত মালিক হিসেবেই পরিচিতি ছিল তার। সওজ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে নতুন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। অর্থমূল্যের দিক দিয়ে মোট নতুন কাজের প্রায় অর্ধেক পেয়েছেন পাঁচ ঠিকাদার। এর মধ্যে অন্যতম এই আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। গত পাঁচ বছরে সড়ক বিভাগে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন, যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ১০০টির মতো। এককভাবে তারা পেয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাজ।
সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানের হাত ধরেই আবেদ মনসুরের কোম্পানির অগ্রযাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি সওজ অধিদপ্তরে ঠিকাদারি শুরু করে বছর সাতেক আগে। সবুজ উদ্দিন খানের আওতায় গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে অধিকাংশ কাজ দখলে নিয়ে তারা বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। সবুজ উদ্দিন খানের সঙ্গে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের এতটাই দহরম-মহরম সম্পর্ক যে অনেকেই সবুজকে ফার্মটির অঘোষিত মালিক মনে করতেন।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান ও মাহমুদা আক্তার পান্নার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা দিয়েও সাড়া মেলেনি।