বুধবার, জানুয়ারী ২২, ২০২৫

অভিযোগ প্রমাণিত, মামলা আদালতে বিচারাধীন তারপরও নির্বাহী প্রকৌশলীকে দায়মুক্তি রাজউকের

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৫:০১ পিএম

অভিযোগ প্রমাণিত, মামলা আদালতে বিচারাধীন  তারপরও নির্বাহী প্রকৌশলীকে দায়মুক্তি রাজউকের

 



রাজধানীকে সুন্দর, মনোরম ও নিরাপদ পরিবেশে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণের কাজ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। কিন্তু মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও আদালতে বিচারাধীন কর্মকর্তাকে। সম্প্রতি এমনই ঘটনা ঘটেছে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল করিমের ক্ষেত্রে। প্রতারণা, মাদকসেবন, টেন্ডার বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য, ঘুষ বানিজ্য ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মতো একাধিক গুরুতর অপরাধমূলক অভিযোগ থাকার পরেও পেয়েছেন পদোন্নতি ও নির্বাহী প্রকৌশলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। 

রাজউক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যায়ন শেষে ২০১৮ সালে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) হিসেবে রাজউকের যোগদান করেন আব্দুল করিম। মাত্র ৬ বছরের মধ্যে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই তিনি টেন্ডার বানিজ্য, ঘুষ বানিজ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদ। এমনকি রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হয়েও জড়িয়ে পড়েছেন মাদকের সঙ্গে। করিমের ইয়াবা সেবনের একটি ভিডিও ও একাধিক ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহলে ওঠে ব্যাপক সমালোচনার ঝড়। 

এলিট কন্সট্রাকশান নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, আব্দুল করিমের প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন তিনি। এ প্রতারণার কারণে ষাট লাখ টাকা খোঁয়া গেছেন এ প্রতিষ্ঠানের। আব্দুল করিমের প্রতারণার থেকে বাঁচতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দিবাকর চন্দ্র রায় দ্বারস্থ হন ঢাকার সি. এম. এম আদালতে। 
আদালতে মামলার কপি থেকে জানা যায়, প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার দিবাকর চন্দ্র রায় আউট সোর্সিং প্রক্রিয়ায় জনবল ও যানবাহন সরবরাহ করেন। তিনি রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বাপেক্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নমূলক কাজ, মানবসম্পদ এবং যানবাহন সরবরাহ করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী করিমের সাথে তার রাজউকে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় কাজের সুবাদে। করিম সুকৌশলে তার ঘনিষ্ঠতা ও বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে ২০২১ সালের ২১ মার্চ থেকে করিমের নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ডাচ বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা এবং বিগত ২১ এপ্রিল একই হিসাব নম্বরে আরও পাঁচ লাখ টাকা ধার নেয়ার কথা বলে গ্রহণ করেন। করিম সহজেই ১০ লাখ টাকা পাওয়ার পর দিবাকর চন্দ্র রায়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে করিম দিবাকরের উদারতা, বিশ্বাস এবং সরলতাকে কাজে লাগিয়ে তার কাছ থেকে আরও অর্থ আত্নসাতের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ২৫ মে এলিট কনস্ট্রাকশনের অফিস গুলশান থেকে নগদ ২০ লাখ টাকা এবং করিমের বোনের বিয়ে উপলক্ষে ২৭ আগস্টে দিবাকরের অফিস থেকে আরও ৩০ লাখ টাকাসহ। চার ধাপে ৬০ লাখ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। 
মামলায় বলা হয়, দিবাকর যেহেতু রাজউকের একজন ঠিকাদার এবং করিম রাজউকের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তিনি করিমের কথিত বিপদে পাশে না দাঁড়ালে করিম মনোক্ষুণ্ণ এবং চলমান ও ভবিষ্যতে রাজউকের কর্মকাণ্ডে বিরোধিতার মাধ্যমে বাধা তৈরি করতে পারেন। তাই দিবাকর নিতান্ত অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও এই বিপুল পরিমাণ অর্থ উল্লেখিত সময়গুলোতে প্রদান করতে বাধ্য হন। প্রতারক করিমের ঋণকৃত সকল টাকা ফেরত প্রদানের সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরে বারবার তাগাদা দিয়েও টাকা ফেরত না পাওয়ায় চিন্তিত হয়ে দিবাকর বিগত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। অর্থ আত্নসাত ও প্রতারণার প্রমাণসহ  আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় ডিবি পুলিশ। 
ওই মামলায় আদালত করিমকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। বিষয়টি রাজউকের নজরে আসলে করিমকে সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা রুজু করে রাজউক প্রশাসন। অর্থ আত্নসাত ও প্রতারণা ছাড়াও গুরতর একাধিক অভিযোগের কারণে করিমকে একাধিকবার সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা প্রদান করে রাজউক। এমনকি রাজউক করিমকে এসব অপরাধের জন্য গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করে দেয়। 
রাজউক সূত্রে জানা যায়, তবে বছর না ঘুরতেই গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে বদলি হয়ে আবার ফিরে এসেছেন রাজউকে, দায়মুক্তি পেয়েছেন বিভাগীয় মামলা থেকে। সহকারী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি পেয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী পদে, হয়ে উঠেছেন রাজউকের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। 
রাজউকের আইন শাখার কর্মকর্তাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইন শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আদালতের সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত। এর বাইরে রাজউকের কিছু করার থাকে না। 
রাজউকের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, করিমের এমন কর্মকাণ্ডে রাজউকের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। করিমের ব্যাপারে রাজউকের দায়মুক্তির সিদ্ধান্তে দূর্নীতি উৎসাহিত হবে। এমনকি তারা বিষয়টিতে দ্রুত কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা যায় আদালত সূত্রে। 
জানতে চাইলে আব্দুল করিম বলেন, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, মাদক সেবনসহ যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সবকিছু মিথ্যা। 
আদালতে বিচারাধীন মামলার অভিযুক্তকে রাজউক দায়মুক্তি দিল কিভাবে এমন প্রশ্নে আব্দুল করিমের তদন্ত কর্মকর্তা প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন ও ডিজাইন) মো. মোবারক হোসেন এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। তবে আমি যা পেয়েছি সেভাবেই তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছি। দায়মুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আমার কাজ নয় এটি রাজউক প্রশাসন করেছে। 
নিজেকে ব্যবহারের বিষয়ে স্বীকার করে তিনি এ বিষয়ে প্রশাসন পরিচালকের সাথে কথা বলতে বলেন। 
প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এ.বি.এম. এহসানুল মামুন জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।