মঙ্গলবার, এপ্রিল ২২, ২০২৫
তিন যুগ পর দেশে এসে দেখেন সব সম্পত্তি বেদখল

সম্পত্তির মালিকানা ফেরত চেয়ে কুমিল্লায় হামলার শিকার ব্রিটিশ নাগরিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৪:০১ পিএম

সম্পত্তির মালিকানা ফেরত চেয়ে কুমিল্লায় হামলার শিকার ব্রিটিশ নাগরিক

২০০৭ সালে ব্রিটেনের উদ্দেশ্য ঢাকা ছাড়েন কুমিল্লার বাঙ্গরা বাজার থানার ৩নং আন্দিকুট ইউনিয়ানের বাসিন্দা নাসিমা আক্তার। পৈত্রিক বাসস্থান কুমিল্লা ছেড়ে ঢাকায় বসবাস করে এবং দীর্ঘ ১২ বছরের উপর চাকুরী করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি, শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে ওখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট নাসিমা, প্রায় তিন দশক পর পাক-দেওরা গ্রামে গিয়ে পৈত্রিক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভাগ চাইলেই হামলার শিকার হন তিনি। নাসিমা আক্তার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। অসহায় হয়ে নাসিমা আক্তার আসেন দৈনিক আজকের বাংলা অফিসে বর্ণনা করেন তার অসহায়ত্বের কথা। ভুক্তভোগী নাসিমা আক্তার আজকের বাংলাকে জানান, পিতা এ বি এম আব্দুল হকের রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার একর। দীর্ঘদিন গ্রামের ও দেশের বাইরে থাকায় এসব সম্পত্তি ব্যবহার করছেন তারই ৪ ভাই ও বড় বোন, এর বাইরে আরো ১৬২ শতাংশ জমির মালিক তারা তিন বোন, সেগুলোও।  

জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করতে পারছেন না নাসিমা। ২০২০ সাল থেকে তার বোন লুৎফা বেগমকে ৪ ভাই এবং বড় বোন ও তাদের ছেলেরা নিয়মিত ভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছেন। একই সাথে অত্যাচার, অপমান, মিথ্যা অপবাদ ও মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করতে থাকে, যাতে করে বোনকে সম্পত্তি দিতে না হয় ও নাসিমা আক্তার  বাড়িতে আসতে না পারে। অভিযোগের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বড় ভাই মোঃ আতিকুর রহমান, বড় বোন হাসিনা বেগম, স্বামী মোঃ আব্দুস সালাম ভূইয়া, হাসিনা বেগমের ছোট ছেলে মোঃ শাহ্ কামাল ভুইয়া (সুজন), বড় ছেলে মোঃ শাহজালাল ভুইয়া (সুমন), ভাই মোঃ এমদাদুল হক (রসিদ), স্ত্রী সৈয়দা মাহবুব আক্তার, এমদাদুল হকের তিন ছেলে মোঃ আসাদুজ্জামান মামুন, মোঃ সারোয়ার জাহান নাঈম,মোঃ নাসিম, সেজো ভাই মোঃ সাজেদুর রহমান, স্ত্রী আলেয়া বেগম, তাদের ৫ সন্তানের মধ্যে মোঃ লুৎফুর রহমান, মোঃ সাইফুর রহমান, ভাই মোঃ জাহাঙ্গীর আল- মামুন, স্ত্রী লাকী বেগম নানা সময়ে হেনস্তা, হুমকি দিতে থাকেন।  

নিজের দুর্ভোগের কথা বলতে বলতে নাসিমা বেগম জানান, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে কুমিল্লায় আমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে তারা আমার সাথে আপত্তিকর আচরণ করতে থাকে। বাড়িতে একটি টয়লেট বানাতে গেলে তাতে বাধা দিয়ে রেখেছে ভাইয়েরা। লুৎফা বেগমকে এ নিয়ে একের পর এক নির্যাতন করে যাইতেছে, এমনকি তাকে লোহার সাবল দিয়ে জানে মারার চেষ্টা এবং বাড়িতে সিসি টিভি ভাঙার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, আমার বাবার সম্পত্তিতে আমার অধিকার আছে, এটা আমার হক, আমি কেন বঞ্চিত হব? আমার ভাইদের কোনো অধিকার নেই আমাকে বঞ্চিত করার। ২০২৩ সালে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম, ভাইয়েরা আমাকে পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ দিতে অস্বীকার করেছে। কিছু দিন আগে আমাদের তিন বোনের ৭৬ শতাংশ জমিতে একটি সাইনবোর্ড দেই তাতে আমাদের ৩ বোনের নাম ও জমির বিবরণ আছে, এই সাইনবোর্ডটি শাহ্ কামাল ও তার সন্ত্রাসী দল ভেঙে উধাও করে দেয়, আমি জমির কাছে গেলে সেখানেও আমার উপর হামলা ও গালি-গালাজ করে।  

১৬ই জানুয়ারী ২০২৫, আতিকুর রহমান ও বড় বোন হাসিনা বেগমের নির্দেশে লুৎফাকে হত্যার জন্য জমির দক্ষিণ পাশে রাস্তার উপর আব্দুস সালাম, শাহজালাল এবং শাহ্ কামাল দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পেছন থেকে অতর্কিত হামলা করে এবং শ্বাস রোধের চেষ্টা চালায়। ঘটনার সময় ভিডিও ধারণ যাতে করতে না পারে লুৎফা বেগমের মোবাইল পাশে ডোবার সাদৃশ্য জমে থাকা পানিতে ফেলে নষ্ট করে দেয়া হয়। কিছুটা দূর থেকে এই হামলার নেতৃত্ব দেয় তার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আল মামুন। লুৎফার চিৎকারে গ্রামের লোকজন চলে আসে, তখন তারা চলে যায়। এরপর জমির সামনে দেখলে নাসিমা এবং লুৎফাকে খুন করে গুম করে দিবে বলে হুমকি দিয়ে চলে যায়। তখন দ্বিতীয় সাইনবোর্ডটিও ভেঙ্গে উধাও করে তারা। নাসিমা আক্তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ইং সেনা ক্যাম্প ও পরে বাঙ্গরা থানায় অভিযোগ করেন। এর পরেও ২০ জানুয়ারি ২০২৫ইং তারিখে তাদেরকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে বাসের মধ্যে নাসিমার ব্যাগে মাদক দিয়ে ফাসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। 

সামাজিক ভাবে হেনস্তা করতে ভাইয়েরা প্রোপাগান্ডার উপর নির্ভর করছে জানিয়ে নাসিমা  বলেন, আমাকে ও বোন লুৎফাকে আমাদের  ভাইয়েরা, বড় বোন ও তাদের সন্তানরা সমাজের কাছে নানারকম মিথ্যা অপবাদ ও তথ্য প্রচার করে প্রতিনিয়ত আমাদের সম্মান হানি করতেছে। দেশে আসলে শুনি তারা গ্রামে আমার নামে নানা ধরনের কথা ছড়িয়েছে। আমি এসব শুনে খুবই হতবাক হই। জানতে চাইলে শাহজালাল ভূইয়া সুমন বলেন, আমার ছোট ভাই মোবাইল পানিতে ফেলে দিয়েছে আমি দেখেছি, কিন্তু হামলার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা চলছে। ছবিতে বোনের উপরে হামলা করতে দেখা গেলেও বিষয়টি অস্বীকার করেন আতিকুর রহমান। তিনি আজকের বাংলাকে বলেন, আমি হামলার বিষয়ে কিছুই জানিনা।
বাঙ্গরা থানা সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ নাগরিক নাসিমা বাঙ্গরা বাজার থানায় অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ পরিদর্শনে এসে হামলার সত্যতা প্রমান পান। তবে এখনো পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করতে পারেননি। থানার পক্ষ থেকে চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত দুই পক্ষের সবাইকে থানায় গিয়ে ঘটনার মিমাংসা করতে বলা হয়। এর আগে কোন পক্ষই যাতে জমিতে না যায় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। কিন্তু রবিবার, ১৯ জানুযারী ২০২৫ইং তারিখে নিষেধ অমান্য করে আতিকুর রহমান, হাসিনা বেগম, মোঃ জাহাঙ্গীর আল মামুন ও অন্যরা তাদের লাঠিয়াল নিয়ে জমিতে ধানের চারা রোপণ করে পুরো সম্পত্তির দখল দাবী করে। লুৎফা বেগম দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, আমাদের আশেপাশে সব সময় দেশীয় অস্ত্রসহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের নজর দারিতে রাখছে। আমরা কোথাও যেতে পারি না, ঘর থেকে বেরোতে গেলেই তারা হেনস্থা করে এবং মেরে ফেলার হুমকি দেয়।  
হামলার বিষয়টি আতিকুর রহমান ও সুমন অস্বীকার করলেও স্বীকার করেছেন শাহ কামাল (সুজন)। তিনি বলেন, হামলার বিষয়ে তারা পুরোপুরি সত্য কথা বলেনি, আমি মোবাইল ফোন ফেলে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু তাদের উপর হামলা করিনি। একই সাথে জমিতে থাকা সাইনবোর্ড ভাঙার কথাও স্বীকার করে তিনি বলেন, লুৎফা নিজের নামে সাইনবোর্ড করেছিলো। আমরা সে সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেছি। নাসিমা বলেন, এই সমস্ত কাজ আতিকুর রহমানের নির্দেশে হয়। আতিকুর রহমান একজন অত্যান্ত হিংসাপরায়ণ, লোভী, ও উনার মতের বিরুদ্ধে গেলেই এই রূপ আচরণ করে থাকে। 
তাই আমার এবং বোন লুৎফা ও তার পরিবারের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক এবং এর দায়ভার বাঙ্গরা থানার পুলিশকে নিতে হবে। আমি একজন ব্রিটিশ নাগরিক, তাই আমার নিরাপত্তা দিতে যদি পুলিশ ব্যর্থ হয় তাহলে ব্রিটিশ সরকারে কাছে পুলিশের দায় স্বীকার করতে হবে। আমি ব্রিটিশ হাইকমিশনসহ সব জায়গায় যোগাযোগ করেছি। জানতে চাইলে বাঙ্গরা থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, বিষয়টি তদন্তের জন্য থানার একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বিষয়টি তদন্ত করছেন। জানতে চাইলে সাব-ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (এসআই) আবুল বাশার আজকের বাংলাকে বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে আসামীরা অপরাধ সংঘঠনের সাথে যুক্ত। তাদেরকে বলা হয়েছে জমি সংক্রান্ত বিষয়ে মীমাংসা ছাড়া কেউ যেন এই জমিতে কোন কিছু না করে। তারপর প্রতিপক্ষরা জমিতে জোর করে ধানের চারা রোপন করেছে যা সম্পূর্ণ অন্যায়। আমরা সামনের দিকে অগ্রগতি পর্যালোচনা করছি।