ক্যাম্পাসে এলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। গত বছর ১৭ জুলাই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়া করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর আর ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেনি তারা। অনেকেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে এসে গ্রেফতার হয়েছেন, আবার অনেকে ঘুরতে এসেও গ্রেফতার হয়েছেন। কারন হিসেবে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগকে তারা আর সহ্য করতে পারছেন না। ছাত্রলীগ জুলাইঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে নিষিদ্ধ হয়েছে, তাই শিক্ষার্থীরা তাদেরকে ক্যাম্পাসে দেখতে চান না।
গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে আসা নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে মারধরের পর পুলিশে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুরে মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা তাঁকে মারধর করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মারধরের শিকার ছাত্রলীগের সাবেক ওই নেতার নাম সামিউল আহসান। তিনি শাখা ছাত্রলীগের কমিটির উপসাহিত্য সম্পাদক পদে ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সামিউল আহসান মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। গতকাল তাঁর ৫০২ কোর্সের পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে কয়েকজন তাঁর পথ আটকায়। পরে সেখানে এক দফা মারধর করা হয় সামিউলকে। বাধা দেওয়ায় তাঁর এক নারী সহপাঠীকেও মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখান থেকে সামিউলকে প্রথমে প্রক্টর অফিসে নেওয়া হয়। প্রক্টরের অনুপস্থিতিতে সেখানে তাঁকে আরেক দফা মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ সহপাঠীদের। পরে সামিউলকে হাটহাজারী থানায় নেওয়া হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে গ্রেফতার নতুন ঘটনা নয়। বিগত আওয়ামী আমলে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে শিবির কিংবা ছাত্রদল সন্দেহে নির্যাতন করা হত। নির্যাতন শেষে তাদের পুলিশে হস্তান্তর করা হত। এটি ছিলো তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠনের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (স্যাট) নামের একটি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে অন্তত ২৭ জন শিক্ষার্থী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জাতীয় পত্রিকা ও গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১৫ বছরে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন কমপক্ষর ৫ হাজার ৩২৭ জন। নিজেদের দলীয় কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭ জন। এ সময়কালে ধর্ষিত হয়েছেন ১৪ জন নারী আর যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ভুক্তভোগী ৬৯ জন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) শাখার ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জিহান পরীক্ষা দিতে এসে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের হাতে আটক হন এবং পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এরআগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জানুয়ারিতে চবির বিলুপ্ত কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক শফিকুর রহমান মেঘ পরীক্ষা দিতে এসে মারধরের শিকার হন। একই মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মামুন অর রশিদ মানোন্নয়ন পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে মারধরের শিকার হন এবং পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। অন্যদিকে, নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুমিত সরকার পরীক্ষা শেষে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন এবং পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে গিয়ে ৩ জন ছাত্রলীগ কর্মীকে গ্রেফতার করে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনার পতনের পর, ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল ফটকে চেকপোস্ট বসিয়ে ছাত্রলীগের ২ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করা হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় আটক হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস আজকের বাংলাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরাসরি মদদপুষ্ট নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো তার ভুক্তভোগী অনেকেই সেসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মামলা করেছেন। সেই মামলার আসামীদের কাউকে ক্যাম্পাসে দেখা গেলে মাঝেমধ্যে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে বলে আমরা দেখেছি। আবার অনেক সময় এসব আসামী মুক্তভাবে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ালেও তাদেরকে পুলিশ গ্রেফতার করে না, বরং ভুক্তভোগীরাই তাদেরকে আটক করে প্রক্টরিয়াল টিমের হাতে সোপর্দ করেছে।
তাই এখন ফ্যাসিবাদের আমলের মতন করে রাজনৈতিক কারণে বানোয়াট মামলা দেখিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ আমি ভিত্তিহীন মনে করি। বরং ছাত্রলীগের পদস্থ বেশিরভাগ নেতাকর্মী যেমন এখনো নিরাপদে ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, ছাত্রদলের পক্ষ থেকে করা মামলাগুলোর ভিত্তিতেও আমরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের হার খুবই কম লক্ষ্য করেছি।
এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি আজকের বাংলাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিলো তখন কিন্তু ছাত্রলীগের একটা বড় গ্রুপ শুধু ছেলে নয়, মেয়েদের গায়েও হাত দিয়েছে, লাঠি পেটা করে রক্তাক্ত করেছে। যাদের কাছে আমাদের ক্যাম্পাসের বোনেরা নিরাপদ না, তাদের সাথে কিভাবে একসাথে ক্লাস করবো। যে মেয়েটি ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, সেই মেয়েটি কিভাবে সেই ছাত্রলীগের কুলাঙ্গারের সাথে বসে ক্লাস করবে। আমরা বিশ্বাস করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীই খুনিদের সাথে ক্লাস করতে চাইবে না। আর তারা যে, ক্যাম্পাসে এসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে না, সে দায়ভার কে নিবে। খুনিদের জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে না, বাংলাদেশেও হবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক জহির উদ্দিন মোঃ বাবর আজকের বাংলাকে বলেন, গত ১৭ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের যে নির্যাতন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর যে হামলা এবং বিভিন্ন আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ফ্যাসিবাদী কায়দায় যে হামলা চালিয়েছিল এর কারণেই ৫ তারিখের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সে ক্ষোভ ও আক্রোশের জায়গা রয়েছে। ওই ক্ষোভ ও আক্রোশের জায়গা থেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পুলিশে দেয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগের অপকর্মের জন্যই ছাত্রলীগকে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।
আইন যা বলছে : গত ২৩ শে অক্টোবর অর্র্ন্তর্র্বতী সরকার বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী সরকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইন অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে গত পহেলা অগাস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। একই আইনে আগে হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, কারো বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অপরাধের অভিযোগ থাকলে গ্রেফতার করা যাবে। তিনি বলেন “ওদের বিরুদ্ধে কোন স্পেসিফিক অপরাধের অভিযোগ থাকলে যেমন মারামারি, গুলি করেছে, আগুন জ্বালিয়েছে ওইটার ক্ষেত্রে সংগঠন নিষিদ্ধ হোক বা না হোক কিছু যায় আসে না, গ্রেফতার করতে পারবে”।