শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশের কোথাও আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই ভারত সহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ নয়, স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দও গা বাঁচাতে ভারতে আত্নগোপন করেছেন।
দেশের বাইরে যাওয়ার ছাড়াও দলটির বড় সংখ্যক নেতা-কর্মীর আশ্রয় হয়ে আওয়ামী লীগের ঘাটি খ্যাত গোপালগঞ্জ। আত্মগোপনে থাকা দলটির নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে এমনটি জানা গেছে। তারা জানান, নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা বিদেশে পালাতে পারেনি, তাদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে গোপালগঞ্জ জেলায়। তবে ছয় মাসেও জেলাটিতে পলাতক নেতাদের মধ্যে চারশত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জামাত-ই-ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রেস সেক্রেটারি আতাউর রহমান সরকার আজকের বাংলাকে জানান, গ্রেফতারের দায়িত্ব তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। যারা অপরাধের সাথে জড়িত, খুনের সাথে জড়িত তাদের গ্রেফতার করতে হবে, এটা তো সবার ই বক্তব্য। তবে প্রশাসনের জায়গা থেকে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী আমলে তো তারা মাটির তল থেকেও নিরপরাধ মানুষকেও ধরে আনছে, আটক করেছে। এখন কেন অপরাধীদের ধরতে পারছে না? আমরা এখনো পুলিশ- প্রশাসনের উপরে আস্থা হারাইনি। হারাতেও চাইনা, তবে কাজে গ্যাপ হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে।
গত ছয় মাসে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হাসিনার পতনের পর দেশের কোথাও আওয়ামিলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখা না গেলেও গোপালগঞ্জে অন্তত ৪ বার প্রকাশ্যে আওয়ামিলীগের কর্মসূচী দেখা গিয়েছে। গতবছরের ১০ আগস্ট, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এদিন চন্দ্রদিঘলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মী ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বিজয়পাশা মোড়ে অবস্থান নেন। মিছিলটি মহাসড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
একই বছরের ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ মিছিল করে। জেলা আওয়ামী লীগ অফিস চত্বর থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে চৌরঙ্গী মোড়ে শেষ হয়। মিছিলে জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের প্রায় হাজারখানেক নেতাকর্মী অংশ নেন। ১৫ আগস্ট জেলা আইনজীবী সমিতি কোর্ট বর্জন করে শেখ মুজিবের শাহাদত বার্ষিকীর কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে হত্যাকাণ্ড চালায় আওয়ামী লীগ। বিকেলে গোপালগঞ্জের ঘোনাপাড়া মোড়ে মাইকিং করে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২০০-৩০০ নেতাকর্মী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জিলানীর গাড়িবহরে ব্যারিকেড দেন। এক পর্যায়ে তারা গাড়ি ভাঙচুর ও নেতাকর্মীদের কুপিয়ে জখম করেন। এঘটনায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রথম শ্রেণির আম্পায়ার শওকত আলী দিদার নিহত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা জানান, গোপালগঞ্জে বর্তমানে আওয়ামিলীগ নেতারা আত্নগোপনে রয়েছে। তবে আত্নগোপনে থাকলেও তারা প্রায়ই তারা প্রত্যান্ত এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফ্যাসিস্ট সংগঠনের নেতারা গোপালগঞ্জে আশ্রয় নিচ্ছে।
একাধিক মামলা হলেও এখনো পর্যন্ত গোপালগঞ্জের কোন প্রথম সারির আওয়ামীলীগ নেতাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। স্থানীয়দের ভাষ্য, ৫ আগস্টের পর গোপালগঞ্জের আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের অনেককেই প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতেও দেখা গিয়েছে। তবে ডেভিল হান্ট ঘোষণার পর থেকে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
লীগ নেতা গ্রেফতারের সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে পুলিশ কাছ থেকেও। গোপালগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মো. নাসির উদ্দিন বলেন, আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের এরেস্ট করছি না। মিডিয়ায় কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গ্রেফতারের সংখ্যা জানতে চাইলেও তিনি প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গোপালগঞ্জ দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে এখানে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়, এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই সাধারণত বিজয়ী হন। গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার অভাব, জবাবদিহিতার সংকট, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ ও অনৈতিক সুবিধা গোপালগঞ্জের মানুষকে আওয়ামীলীগের প্রতি সমর্থনের পালে হাওয়া দেয়। এছাড়াও বিগত ১৫ বছরে সারাদেশের নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য সহ যাবতীয় ব্যবসা- বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গোপালগঞ্জের মানুষ এক চেটিয়া সুবিধা লাভ করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। এসব অনৈতিক সুবিধা নিতে এবং ক্ষমতাসীনদের ক্রোধ এড়াতে সবাই আওয়ামী লীগের খাতায় নাম লেখান। হাসিনার পতন তারা মেনে নিতে পারছে না। তারা ভাবছে, এখনো তারা সেই ফ্যাসিবাদের সাম্রাজ্যে আছেন।
এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের আজকের বাংলাকে জানান, সরকার যদি ডেভিল হান্ট অভ্যূত্থানের পর পর ই শুরু করত, তাহলে এসব রাঘব-বোয়ালগুলো আইনের জালে ধরা পড়ত। গোপালগঞ্জে আওয়ামি লীগের ঘাটি রয়েছে। সরকার নানান জটিলতার কারনে সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছে না। তাদেরও কিছু প্রতিবন্ধকতা, ব্যর্থতা-দূর্বলতা রয়েছে। আমি আশা করবো, সরকার সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠবে। দেশে স্থিতিশীলতার জন্য এবং বিপ্লবের স্পিরিট ধরে রাখতে পতিত সরকারের রাঘব বোয়ালদের অতি সত্ত্বর আইনের আওতায় আনা ছাড়া কোন উপায় নেই। শুধুমাত্র চুনোপুঁটি ধরে দেশকে স্থিতিশীল ও বিপ্লবের স্পিরিটকে সমুন্নত রাখা যাবে না।