শুক্রবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৫

নির্বাচনে অনীহা প্রশাসকের, আর্থিক ক্ষতির মুখে উদ্দীপন

ইমরান নাফিস

প্রকাশিত: ০৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১২:০৪ এএম

নির্বাচনে অনীহা প্রশাসকের, আর্থিক ক্ষতির মুখে উদ্দীপন

নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা থাকলেও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসক এ এইচ এম নুরুল ইসলামের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ ও অনধিকার চর্চার কারণে কার্যত অচলাবস্থার মুখে পড়েছে ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উদ্দীপন। মাঠপর্যায়ের কর্মীরা দায়িত্বরত প্রশাসকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, হয়রানি ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন। এ পরিস্থিতিতে, প্রশাসকের অদক্ষতায় তিনমাসে ২০০ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি, যা প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যকে বিপদে ফেলেছে। ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ এইচ এম নুরুল ইসলামকে ৯০ দিনের জন্য উদ্দীপনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল—নির্বাচনের মাধ্যমে বোর্ড গঠনের পথ সুগম করা ও অনিয়ম তদন্তে প্রয়োজনে সুপারিশ প্রদানই হবে তার মূল দায়িত্ব। তবে বাস্তবে নির্বাচন আয়োজনের পরিবর্তে তিনি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলে প্রশাসনিক ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে প্রশাসকের পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে এবং ঋণ আদায় কার্যক্রমে বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রশাসক নিয়োগের পর ৯০ দিনের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে নানা অজুহাতে আরও ৬০ দিনের মেয়াদ বৃদ্ধির অনুরোধ করেন তিনি এবং তা অনুমোদনও পেয়ে যান। তবে অতিরিক্ত এই সময়েও নির্বাচনের কোনো লক্ষণীয় অগ্রগতি নেই। বরং, মাঠপর্যায়ে কর্মরত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে প্রশাসকের পছন্দসই ব্যক্তিদের বসানো হয়েছে, যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে এবং ঋণ আদায় কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উদ্দীপনের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৮০ কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ২০২৫ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৬৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮৯ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনিটরিংয়ের অভাব, কর্মকর্তা সরানো, এবং প্রশাসনিক অস্থিরতা এর অন্যতম কারণ। আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে জুলাই ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ সময়কালের খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যানে। উদ্দীপনের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে যেখানে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২৮,৫৭৬ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ ছিল ২,০৯৮ কোটি টাকা (ODR ৭%), ২০২৫ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪,৫৫০ কোটি টাকায়—যা মোট ঋণের ১৬ শতাংশ। ৯ মাসে খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়া প্রতিষ্ঠানটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে দৈনিক আজকের বাংলার কথা হয়। চাকুরী নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তারা জানান, “এর পেছনে বড় কারণ হলো মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ের ঘাটতি ও মনিটরিংয়ের অনুপস্থিতি। আগে টার্গেটভিত্তিক আদায় কার্যক্রম থাকলেও এখন তা নেই বললেই চলে। কেউ আর দায়িত্ব নিতে চাইছে না, কারণ নিজের চাকরি নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে।” তারা আরও বলেন, প্রশাসনের অনেকেই নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে দায়িত্ব বহির্ভূত কাজে জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করেন, যার ফলে সংস্থার নিয়মিত কাজ ক্ষমতাসীন কয়েকজনের মর্জির উপর নির্ভর করে আছে। এমন পরিস্থিতিতে সংস্থার সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন ও নির্বাচিত বোর্ড গঠনের দাবি জোরালো হয়েছে। তারা মনে করছেন, কেবল একটি গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বশীল বোর্ডের মাধ্যমেই সংস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে, প্রশাসকের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তারা মনে করছেন, প্রশাসকের অতিরিক্ত মেয়াদ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের আয়োজন নিশ্চিত করা উচিত। তা না হলে ঋণ আদায়ের হার আরও কমে যাবে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। এবিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইদুর রহমান খানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।