বুধবার, জানুয়ারী ২২, ২০২৫
logo

১৯৯১ সালে ছাত্রদলের বাঁধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় ডাকসু নির্বাচন

পরিবেশ না থাকার অজুহাতেই বন্ধ হয় নির্বাচন


আতিক আকাশ প্রকাশিত:  ০৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ১১:০১ পিএম

১৯৯১ সালে ছাত্রদলের বাঁধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় ডাকসু নির্বাচন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ১৯৯১ সালে। ওই সময়ে বিএনপির সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে তফসিল ঘোষণা করেও নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলেও ডাকসু নির্বাচন আয়োজন আর করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে তৎকালীন উপাচার্ অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ ডাকসু নির্বাচনের তাফসিল ঘোষনা করলেও সেবার ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বাঁধার মুখে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। 
সম্প্রতি ৫ আগস্ট গণঅভ্যূত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ডাকসু নির্বাচনের দাবি তোলে শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে শুরু হয়ে আলোচনা-সমালোচনা। সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলো নির্বাচনের অনুষ্ঠানের বিষয়ে একমত হলেও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে তাদের মধ্যে। এরই মধ্যে ডাকসু নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সংস্কারের আগে ডাকসুর বিষয়ে আলোচনা না করার দাবি জানাচ্ছেন। ডাকসুর দাবি জোরালো হয়েছে নতুন বছরের শুরুতেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত হওয়া অন্তর্র্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের একটি সময়সীমা উল্লেখ করেছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট সব ছাত্রসংগঠনের ঐক্যও বিনষ্ট হতে পারে। এতে করে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্ন হওয়াসহ জাতীয় রাজনীতিতেও এর দীর্ঘমেয়াদি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালের মার্চে। ওই সংসদের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর দীর্ঘ ৪ বছর বন্ধ নির্বাচন। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা দাবি জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন করে আবার ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ওঠে। তবে ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের আগে সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন আজকের বাংলাকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। আমরা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার পক্ষে। ২০১৯ সালে সর্বশেষ যে ডাকসু হয়, তখন যে গঠনতন্ত্র ছিল, তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। এটি নিয়ে আমাদের সংস্কারের প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দেব। আর সেই সংস্কারগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর উপযুক্ত সময়ে আমরা ডাকসু নির্বাচন চাই। অবশ্যই ডাকসু নির্বাচনের আগে আমরা সংস্কারের সর্বোচ্চ দাবি জানাব।
নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯০ এর ৬ জুন নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা নির্বাচনের তাফসিল ঘোষনা করেন। তখনকার ছাত্রদল নেতারা ছাত্রত্ব ঠিক ও প্রার্থী হওয়ার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি করে। এ নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় তখন নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যায়। 
১৯৯৪ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ ডাকসুর তাফসিল ঘোষনা করেন। কিন্তু পরিবেশ না থাকার অভিযোগ এনে সে সময়ের বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বাধার মুখে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। একইভাবে ১৯৯৫ সালে নির্বানের তাফসিল ঘোষনা করা হয় কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী উপাচার্য নির্বাচিত হওয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানান। কিন্তু নির্বাচনের তাফসিল ঘোষনায় ব্যর্থ হন তিনি। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে অভ্যন্তরীন দ্বন্ধে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হয়। ওই ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৮ সালে প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে তখনকার মেয়াদোত্তীর্ণ ডাকসু ভেঙ্গে দেওয়া এবং পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে। 
সে অনুযায়ী সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এরপরও অধ্যাপক এ. কে. আজাদ চৌধুরী দু’বার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিরোধী ছাত্র সংঘঠন ছাত্রদল সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগীতার ফলে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি।
এ দশকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেই হলে হলে দখলদারিত্ব ও ক্যাম্পাসজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হতো। ১৯৯২ সালের ২৯ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, ‘একটি ধারণা জন্ম নিয়াছে যে, হল দখলের মাধ্যমে ডাকসু ও হল সংসদগুলির নির্বাচনে জয় লাভ করা যাইবে অথবা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হইবে।’
সে সময় ডাকসুর জন্য গঠিত নতুন (সংশোধিত) গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙ্গার ছয় মাসের মধ্যে পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার দুই দশকের বেশী সময়েও ডাকসুর তাফসিল ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। ২০০৫ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ভিসির ওই ঘোষনার পর ছাত্র সংঘঠনগুলোর মধ্যে চঞ্চলতা দেখা দেয়। ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার মিছিল সমাবেশ ও ভিসির কাছে স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগীতার ফলে তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকি ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডাকসু নির্বাচনের জোর দাবি উঠে। শিক্ষার্থীরা পৃথক মঞ্চ করে আন্দোলনও করে। এ নিয়ে ডাকসু নির্বাচনের দাবি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয় আরফিন সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২০১২ সালে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল ও ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। 
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ তৈরী করে লাগাতার কর্মসূচীও চলে বেশকিছু দিন। ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশনা চেয়ে এরই মধ্যে উচ্চ আদালতে দু’টি রিট আবেদন করা হয়। প্রথমটি  ২০১২ সালের ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ওই বছরের ৮ এপ্রিল রুল জারি করে। আর দ্বিতীয় রিটটি করে ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মুশতাক আহমেদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রিটের শুনানি শেষে নির্ধারিত সময়ে ডাকসু নির্বাচন কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে হাইকোর্ট ৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন দশক পর অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন। 
জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার আজকের বাংলাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ডাকসু নির্বাচন চাচ্ছে। তবে ডাকসুর গঠনতন্ত্র নিয়ে অনেক ধরণের প্রস্তুাবনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে আলোচনা করছে, আমাদের সাথেও আলোচনা করেছে। গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়টি এখন আলোচ্য বিষয় হিসেবে সামনে এসেছে। আমরাও কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম ছাত্রদের ক্ষমতায়ন। বর্তমানে উপাচার্য মহোদয়ই ডাকসুর প্রেসিডেন্ট হন। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকেই প্রেসিডেন্ট করা এবং পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক একটি পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনা আমরা দিয়েছি। 
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সম্প্রতি বলেছেন, ডাকসু আমাদের অঙ্গীকার। ডাকসুর জন্য একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কমিটি সব অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে সুপারিশ জমা দেবে। সেই সুপারিশের আলোকেই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা কাম্য।