মোহাম্মদ খোরশেদ হেলালী , কক্সবাজার প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৪:০১ পিএম
কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং এবং তার স্ত্রী সাবেক এমপি এথিন রাখাইনের বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
এনিয়ে বুধবার (৮ জানুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন ও দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক) কক্সবাজার কার্যালয় বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন কক্সবাজার সিটি কলেজের এডহক কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য এডভোকেট রফিকুল ইসলাম।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজার সিটি কলেজ জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী ও স্বনামধন্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০০০ সালে তৎকালীন গভর্নিংবডির সভাপতি এবং আওয়ামী লীগ সরকার আমলের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য এথিন রাখাইন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তার স্বামী ক্য থিং অং কে যোগ্যতা না থাকা স্বত্বেও অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এথিন রাখাইন মহিলা সংসদ সদস্য হিসাবে সিটি কলেজের সভাপতি মনোনীত হন। ২০১৪ সালে মহিলা সংসদ না হয়েও আবারো সভাপতি মনোনীত হয়ে
২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর প্রায় ১৪ বছর স্বামী-স্ত্রী অধ্যক্ষ ও সভাপতি হিসাবে তাদের অনুগত লোক দিয়ে গভর্নিং বডি গঠন করে কক্সবাজার সিটি কলেজ দূর্নীতি ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে।
দুর্নীতির খাত সমূহ হলো -
১। কমিশন এজেন্টের মধ্যমে বিভিন্ন, ভর্তি কমিটি, ফরম পূরণ কমিটি, অভ্যন্তরীন পরীক্ষা কমিটিসহ প্রায় ৩০০ কমিটির সম্মানী বিল হিসাবে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩,৫০,০০,০০০/- (তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা গ্রহণ করেছে।
২। বার্ষিক সম্মানী বিলের নামে প্রতি বছর অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ (৪,৫০,০০০+২,৭০,০০০)=৭,২০,০০০/- (২০২৩) সাল এককালীন বিল গ্রহণ করেছে।
৩। রিসোর্স ভবন তৈরি করে বিনা টেন্ডারে ২,৪৫,০০,০০০/- (দুই কোটি পয়তাল্লিশ লক্ষ) টাকা খরচ করে প্রায় ৫০,০০,০০০/- (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা অনিয়ম ও ভুয়া ভাউচারে আত্মসাৎ করেছে।
৪/ স্টীল ভবন তৈরি করে কোন নিয়ম রেজুলেশন কমিটি ছাড়া ভুয়া ভাউচার করে ৬ কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
৫। বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য তৈরির নামে ৭,০০,০০০/- (সাত লক্ষ) টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং বঙ্গবন্ধু আন্ত:কলেজ ফুটবল টুর্নামেন্টে অস্বাভাবিক বিল করে উক্ত টাকা গ্রহণ করেছে।
৬। ২০১০ সাল থেকে স্বামী-স্ত্রী গভর্নিংবডি কমিটি ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন। অধ্যক্ষ ও তার স্ত্রী সভাপতি হওয়ায় আর্থিক সুবিধা নিয়ে, দলীয় বিবেচনায়, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে মাউশি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি বিধান ও নীতিমালাকে তোয়াক্কা না করে অধিকাংশ শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করে প্রায় ২ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাই এবং আগস্টে ৫ বিষয়ে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রায় কোটি টাকা দুর্নীতি করে আয় করেছেন। তবে তখনকার কমিটির সভাপতি, সাবেক পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলমের বলিষ্ট ভূমিকায়, অনিয়ম দুর্নীতির ফলে ২৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ অনুমোদন হয়নি । বর্তমানে এডহক কমিটির ক্ষমতা না থাকায় অনুমোদনের জন্য নিয়োগ স্থগিত আছে।
অভিযুক্তরা ভুয়া ভাউচার করে, বিভিন্ন খরচের ভাউচার তৈরি করে ভারপ্রাপ্ত অফিস সহকারীর মাধ্যমে নিয়মনীতি ছাড়া যোগসাজসে কলেজের প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
অধ্যক্ষ কর্তৃক স্বাক্ষরিত কলেজের সমুদয় বকেয়া দেনা:
১। সমাজ বিজ্ঞান ভবন (আরবি-২) = ২২,৩৫,৯১৭ টাকা বকেয়া বিল।
২। বেতন বকেয়া অক্টোবর/২০২৪ শিক্ষক কর্মচারী (২০-৩২
মাস)=৯,০২,৯৪,৬৭৪ টাকা।
৩। বেতন বকেয়া কর্মচারী (ব্যাংক হিসাবে খোলেন) =৫২,০০০ টাকা।
৪। অনার্স মাস্টার্স বিভাগীয় বিল বকেয়া =১,৩৭,৮২,৯৮৩ টাকা।
৫। শিক্ষক কর্মচারীর কল্যাণ তহবিল বকেয়া =৭৪,৩১,০৮৭৩ টাকা।
৬। বিভাগীয় দায়িত্ব পালন ভাতা/২৩ =৮৭৫০০ টাকা।
৭। বিভাগীয় দায়িত্ব পালন ভাতা/২৪ =১,৭৭,২৫০০ টাকা।
সর্বমোট -আটারো কোটি পঁচিশ লক্ষ ছত্রিশ হাজার চারশত সাতচল্লিশ টাকা। বর্তমান কলেজে কোন ফান্ড নাই। উল্লেখিত দূর্নীতির কারণে এসব টাকা দায় দেনা হয়েছে।
নগদ অর্জন:
আসামীগণ সিটি কলেজের টাকা আত্মসাৎ করে অডেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অধ্যক্ষ ও সভাপতি স্বামী-স্ত্রী হিসাবে ৫ম তলা বিল্ডিং, ২৫.০০ একর জমির উপর খামার বাড়ীসহ প্রচুর সম্পদ অর্জন করেন।
অন্যান্য অভিযুক্ত কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ আবু মো: জাফর সাদেক, সহকারী লাইব্রেরিয়ান সুমন্ত চন্দ্র রায় একইভাবে বড় বড় দালান তৈরি করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এবং ভারপ্রাপ্ত অফিস সহকারী তিনটি পদ ব্যবহার করে চতুর্দিকে আয় করে ভিন্ন জেলা থেকে এসে ২টি ৩ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং এর মালিক বনে গেছেন। যা তদন্তে সাপেক্ষে প্রমাণিত হবে।
কমিশন এজেন্টের প্রক্রিয়া :
অধ্যক্ষকে ৪০,০০০ টাকা, উপাধ্যক্ষকে ৩৮,০০০ টাকা সম্মানী দিয়ে বিভাগীয় প্রধান নিজের জন্য বিল করেছেন ৩৫,০০০ টাকা। এভাবে পরীক্ষার সম্মানী বিলের নামে প্রতিযোগীতামূলক কমিশন বাণিজ্য করে কলেজের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। রিসোর্স ভবন, আরবি ২ ভবন, ভাস্কর্য তৈরিতে এবং টুর্নামেন্টে সমূদয় টাকা খরচে ম্যানেজিং কমিটির কোন প্রকার অনুমোদন বাজেট প্রণয়ন, নীতিমালা মতে কমিটি, হিসাব কমিটি ছিল না। সভাপতি স্ত্রী হওয়ায় অধ্যক্ষ নিজের ইচ্ছামত টাকা খরচ করে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে বিভিন্ন খাতে গরীব ছাত্রের ফিঃ বাবাদ দেওয়া প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। উপাধ্যক্ষ স্বামী স্ত্রীর কমিটিকে আত্মসাতের সুযোগ দেওয়ার জন্য নিজের সম্মানী বিল গ্রহণ করেছেন এবং বিভিন্ন খাতে টাকা খরচের ভুয়া ভাউচার তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
নিয়মিত অফিস সহকারী থাকা স্বত্বেও সহকারী লাইব্রেরিয়ানকে ভারপ্রাপ্ত অফিস সহকারীর দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন ভুয়া ভাউচার তৈরি করেছেন এবং তাকে সম্মানী বিল দিয়েছেন। সকল শিক্ষকের ২০-৩২ মাস বকেয়া বেতন থাকলেও অধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত হিসাব রক্ষকের কোন ধরনের বেতন বকেয়া নেই। ২০১৫ সালের পূর্বে নিবন্ধন কোন শিক্ষককে চাকুরী স্থায়ী করণ না করলেও অধ্যক্ষ তার ভগ্নিপতি মং ওয়ান নাইন কে নিয়োগের পর হতে কোন বিধি বিধান মানা হয়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যাণ ফান্ডের টাকা ১০ শতাংশ জমা হলেও ২০১৭ সালের জুলাই হতে শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যাণ ফান্ডের টাকা ব্যাংকে জমা করেননি। বর্তমানে কল্যাণ ফান্ডের বকেয়া সাত কোটি তেতাল্লিশ লক্ষ দশ হাজার আটশত তেরো টাকা। মংওয়ান নাইনের কারণে অপর ১২ জন শিক্ষককে স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
বিনা টেন্ডারে উন্নয়ন কাজ:
অধ্যক্ষ তার স্ত্রী সভাপতি হওয়ার সুবাধে কমিটির অন্যান্য সদস্যকে তোয়াক্কা না করে সহকারী লাইব্রেরিয়ান সুমন্ত চন্দ্র রায়কে হিসাব রক্ষক পদে বসিয়ে গরীব ছাত্রদের ফি এর টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বিনা টেন্ডারে রিসোর্স ভবন ও সমাজ বিজ্ঞান ভবন দুটি বহুতল ভবন, বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য নির্মাণ করে প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। স্বামী-স্ত্রী কমিটি হওয়ায় তার দূর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায়না। গরীব ছাত্রের বেতনের ফি এর টাকা খরচে কোন প্রকার নিয়ম নীতি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাউশি এর বিধান অনুসরন করা হয়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কলেজের নিজস্ব তহবিল হতে আসামীগণ ২০ কোটি টাকা বিভিন্ন অজুহাতে বেআইনী ও অবৈধ ভাবে আত্মসাৎ করে, অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। যা তদন্ত করলে সঠিক তথ্য উদঘাটিত হবে । কক্সবাজার সিটি কলেজে গত ১০ বছরের কোন অডিট কমিটির রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি।
জেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করে দায়িত্ব হস্তান্তরের চেষ্টা:
আগামী ২০২৫ সালের ১৫ই জানুয়ারী অধ্যক্ষ অবসরে যাবেন। শিক্ষকদের মধ্যে বিবাধ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তিনি জেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাউশি এর বিধান লঙ্ঘন করে ৫ জনের বহির্ভূত তালিকাভুক্ত শিক্ষককে দায়িত্ব হস্তান্তর করে নিজের দূর্নীতি ও অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এমতাবস্থায় অধ্যক্ষ অবসরে যাওয়ার পূর্বে (১৫ জানুয়ারী) পরিদর্শন টিম গঠন করে তদন্ত পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক। দূর্নীতি দমন কমিশন আইনের বিধানমতে দূর্নীতিবাজ, অর্থ আত্মসাতকারী আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন কলেজের এডহক কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য এডভোকেট রফিকুল ইসলাম।
এবিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, অভিযোগটি ঠিক কি কারণে করা হলো বুঝতে পারছিনা। কলেজ ফান্ডের টাকা দুর্নীতি করার মতো এতো টাকা কোথায়? অভিযোগের বিষয়টি আসলে ভিত্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য।