সাদ্দাম হোসাইন প্রকাশিত: ১২ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৭:০১ পিএম
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে গত ১৭ ডিসেম্বর উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার হতে ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার হতে ৫০ শতাংশ কোটা রাখার বিষয়ে সুপারিশ করবেন বলে মতামত প্রদান করেন। এহেন অসম বন্টন নীতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা মেনে নিতে পারেননি। তারা সমান সুযোগ দাবি করেছেন, যা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল উক্ত প্রস্তাবে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজনও অর্ধেক পাওয়া স্বত্ত্বেও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। প্রতিবাদস্বরূপ তাদের কেন্দ্রীয় সমিতি ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিট্রটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন’ জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডেকে ২ পাতার একটি প্রতিবাদলিপি দিয়েছেন। যা স্ট্যান্ডার্ড ফন্ট করলে কমপক্ষে ৪/৫ পাতা হওয়ার কথা। আবার বাংলাদেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকগণও এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। (দি ডেইলি স্টার বাংলা, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪)। বলতে গেলে এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোটখাটো একটি বিতর্কের ঝড় বয়ে গেলো।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যখন গঠিত হয় তখন থেকে বিষয়টি নিয়ে খুব সমালোচনা চলছে। এই সংস্কার কমিশনের সদস্যগণের মধ্যে একমাত্র ছাত্র প্রতিনিধি ব্যতীত বাকি সকলে প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। যে কারণে এই কমিশনের ওপরে অন্যান্য ক্যাডারের লোকজন ভরসা করতে পারেনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো স্বয়ং জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশই প্রশাসন ক্যাডারের অফিসাররা মেনে নিতে পারছেন না। তীব্র ভাষায় এবং সংঘবদ্ধভাবে তারা কমিশনের মূল একটা প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন। প্রশ্ন হলো যেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিশন কর্তৃক তাদেরই অনুকূলে দেয়া পক্ষপাতদুষ্ট প্রস্তাব মেনে নিতে পারছেন না, সেখানে তারা নিরপেক্ষ প্রস্তাব কিভাবে সহ্য করবেন?
জনপ্রশাসনে সংস্কারের অংশ হিসেবে ‘ক্যাডার’ শব্দটির বিলুপ্তি এবং ‘জেলা প্রশাসক’ পদের নাম পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে। এছাড়া সংস্কার কমিশন প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদমর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে (প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪)। যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে উক্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল, এগুলো কি সেই অর্থে বিশেষ কোন সংস্কারের মধ্যে পড়তে পারে? সংস্কারের প্রশ্নে এগুলো খুব মামুলি বিষয়। যেখানে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়মিত পদোন্নতি বঞ্চিত হন, সেখানে প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব কোন যুক্তিতে সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে? জনপ্রশাসন সংস্কারের অন্যতম দিক হলো সকল ক্যাডারের আত্মমর্যাদা ও সমতা নিশ্চিত করা এবং কোন একক ক্যাডারের খবরদারি করার রীতি দূর করা। এই জায়গায় সংস্কার তো দূরের কথা, হাত দেয়ার সাথে সাথে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন।
বিভিন্ন সভা সেমিনারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ প্রশাসনের উপসচিব হতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও যুগ্ম সচিব হতে জেলা প্রশাসক নিয়োগের কথা বললেও এখন সেগুলো নিয়ে তেমন কোন তোড়জোড় আছে বলে মনে হচ্ছে না। জনবান্ধব ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন অতীব জরুরি বলে মনে করি।
অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের সাথে প্রশাসন ক্যাডারের বৈষম্য প্রকট। প্রশাসন ক্যাডারের নিজস্ব কোন বিশেষ কর্ম না থাকায়, জেলার অন্যান্য অফিস ও কর্মকর্তাদের ওপর খবরদারি এবং নজরদারি করাই হয়ে গেছে তাদের মূল কাজ। বিশেষ দায়িত্ববিহীন কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাধর এই ক্যাডার অনেকের কাছেই অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় এর বিলুপ্তির জন্যও কেউ কেউ সুপারিশ করেছেন।
প্রশাসনের লোকজনের ব্যাপারে বলা হয়, তারা সকল কাজের কাজি হতে চান। দেশে এমন কোন সরকারি কর্মক্ষেত্র পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে, যেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনুপস্থিত। এমনকি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল পোস্টগুলোও তাঁরা দখল করে থাকেন। বিভিন্ন ক্যাডার ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আর সবগুলো মন্ত্রণালয়ের ভালো পোস্টে বসে আছেন প্রশাসনের লোকজন। সেখানে থেকেই সকল ক্যাডারকে তারা শাসিয়ে বেড়ান। এইটা অন্যান্য ক্যাডারের জন্য আত্মমর্যাদায় আঘাতের মত। আবার অন্য ক্যাডারের কর্মক্ষেত্রের মূল সমস্যা তাদের প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয় না। সেই সমস্যাসমূহ সমাধানে তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোতে বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও আগ্রহের ঘাটতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন- একজন ডাক্তার দীর্ঘদিন ডাক্তারি পেশায় থেকে হাসপাতালের এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবেন এবং এর সমাধানের পথ অনুধাবন করতে পারবেন তা একজন বাইরের মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। অন্য সকল ক্যাডারদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাষ্ট্রে একমাত্র তারাই আমলা এবং ফলত মন্ত্রণালয়গুলোর শতভাগ পোস্ট তাদেরই অধিকার। তাদের এই ধারণাটাই ভুল।
বস্তুত বাকি সকল ক্যাডারও সমানভাবে আমলাতন্ত্রের অংশ। প্রশাসন এতোকাল সরকারকে জিম্মি করে ৭৫ শতাংশ কোটা আদায় করে নিয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে একতরফা এবং অন্যায্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ অন্যান্য সার্ভিস সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের অফিসারগণের পদায়ন সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যার যার খাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্যদেরই পদায়ন হওয়া উচিত৷ প্রশাসন ক্যাডার নিজেদেরকে যেমনভাবে সর্বেসর্বা মনে করেন সেটা আদতে সত্য নয়। এ সমস্ত কারণে বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আন্দোলন প্রধানত তাদের আত্মমর্যাদার লড়াই বলেই মনে করি। এই আন্দোলন একই সাথে আন্তঃসার্ভিসের মধ্যে বৈষম্য নিরসনের লড়াই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ডাক্তারদের কাছেই থাকা উচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থাকা উচিত শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে। এভাবে অন্য সকল ক্যাডার অফিসারদের অধীনে তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দিয়ে দেয়া উচিত৷ এটা বাস্তবায়িত হলে একজন ডাক্তার, শিক্ষক, কৃষি কর্মকর্তা কিংবা ইঞ্জিনিয়ার আর তখন নিজের সেক্টর বাদ দিয়ে অ্যাডমিন ক্যাডার হওয়ার জন্য ছুটে বেড়াবে না। নিজের অর্জিত জ্ঞানের নিজের কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করবে এবং আত্মতৃপ্তি পাবে। কখনো হীনমন্যতায় ভুগবে না৷ একই সাথে সকল ক্ষেত্রে একটি দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসন নিশ্চিত হবে। অন্যথা সকল ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্ব, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ও রেষারেষি রেখে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
এই প্রেক্ষিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাহেবের লিখিত ‘বিচার ও প্রশাসন: ভেতর থেকে দেখা’ বইয়ের কিছু কথা প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘একটি বিষয় আমাকে চিন্তায় বিব্রত করত যে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিভাগ বা সংস্থা বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও তার শীর্ষ পদগুলো দখলে রাখার চেষ্টা করতেন। অন্তত আবহাওয়া, মহাকাশ গবেষণা, আণবিক শক্তি কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদসমূহ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ক বিশেষজ্ঞের অধীনেই ন্যস্ত হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছে।’ (পৃষ্ঠা ৩৩১)
একটি বিসিএস পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করেই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদেরকে অন্য সকলের তুলনায় বেশী মেধাবী বলে মনে করেন। সম্ভবত উক্ত কারনেই অন্য ২৫ ক্যাডার হতে নিজেদের আলাদা ভাবেন। এই ধারণা পোষণ করা স্বাভাবিকভাবেই একটি মারাত্মক সমস্যা। প্রশাসন ক্যাডার যদি নিজেদেরকে এতোটাই মেধাবী মনে করে থাকেন, তাহলে কোন কোটা সংরক্ষণ না করে উপসচিব পদে নিয়োগ নতুনভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমেই বাছাই হওয়া বাঞ্চনীয়। তাহলে সেক্ষেত্রে সকল ক্যাডারের জন্য সমান সুযোগ থাকবে। যারা পরীক্ষায় এগিয়ে থাকবে কেবল তারাই উপসচিব হতে পারবে। কিন্তু তারা এই প্রস্তাব মানবে বলে মনে হয় না।
তাছাড়া নিজেদের মেধাবী মনে করা মানসিক দীনতার লক্ষণও বটে। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকলেই প্রশাসন ক্যাডারকে পছন্দক্রমে প্রথমে রাখেন, সেটাও তো সত্য নয়। পছন্দ অনুযায়ী অনেকেই পররাষ্ট্র, পুলিশ, ট্যাক্স, কাস্টমস ও শিক্ষাসহ অন্যান্য টেকনিক্যাল ক্যাডার প্রথম চয়েস দিয়ে থাকেন। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার আছেন যাদের প্রথম চয়েস প্রশাসন ক্যাডার ছিলো না।
প্রশাসন ক্যাডারের মাত্রারিক্ত ক্ষমতা এবং অধিক সুযোগ-সুবিধার কারণে বেশিরভাগ চাকরি প্রত্যাশীরা এই ক্যাডার প্রথম চয়েস রাখতে বাধ্য হয়- এটা সত্য৷ এই জন্য অন্য ক্যাডারে নির্বাচিত হয়েও অনেকে বার বার বিসিএস দেয় কেবল প্রশাসন কিংবা পুলিশ ক্যাডার পাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। একজন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিংবা কৃষি ক্যাডার যখন দেখেন তার চেয়ে বয়সে ছোট একজন ইউএনও তাকে হুকুম দিচ্ছে, কিংবা প্রশাসনের কর্মকর্তারা তার পোস্টিং এবং প্রমোশন নিয়ন্ত্রণ করছেন, এটা তার মানতে খুব কষ্ট হয়। তখন তার নিজেকে ছোট মনে হয়৷ সে তখন বিবেচনা করে যে চাইলে তো সে নিজেই প্রশাসন ক্যাডার হতে পারে। এভাবে শুরু হয় আডমিন ক্যাডার হওয়ার প্রতিযোগিতা। একটি সুস্থ ও জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়তে হলে প্রশাসন ক্যাডারের এরূপ মাতুব্বরি সমূলে ধ্বংস করতে হবে। টেকনিক্যাল কিংবা অন্যান্য ক্যাডার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর কিংবা সংস্থা ইত্যাদিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোন কাজ নাই। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্যাডাররাই তাদের কর্ম সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি দক্ষ ও জ্ঞাত। অন্য ক্যাডারের চেয়ারে বসে খবরদারি করার চিন্তা ব্রিটিশ কলোনিয়াল মানসিকতার ধারাবাহিকতা।
এখন রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য একটি উত্তম সময় ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২৩ টি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও একটিও আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হয় নি। কেন আলোর মুখ দেখেনি তা হয়ত আমাদের এতোদিনে আর বুঝতে বাকি নেই। প্রশাসনের কর্মকর্তারাই চান না যে এখানে কোন সংস্কার আসুক। সংস্কারের কথা শুনলেই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। জনপ্রশাসন সংস্কার সম্ভব হলে দেশের সকল সেক্টরই খুব দ্রুত জনবান্ধব হয়ে উঠবে। সংস্কারের উদ্যোগ যাতে ব্যর্থ না হয়, সেজন্য নাগরিক সমাজকে যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। প্রশাসনিক জটিলতার কারণেই বেশিরভাগ সেবাখাতের মূল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কোন গোষ্ঠী স্বার্থকে উপেক্ষা করে সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিতে হবে।