বুধবার, জানুয়ারী ২২, ২০২৫
logo

ওটিটির আধিপত্যে কমেনি টেলিভিশনের জৌলুস


নাজমুল হাসান প্রকাশিত:  ১৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ০২:০১ পিএম

ওটিটির আধিপত্যে কমেনি টেলিভিশনের জৌলুস

Íদেশে ওভার দি টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে। ওই বছরই নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে বঙ্গবিডি। পরের বছরের জানুয়ারিতে ইউটিউবে নিজেদের ক্ল্যাসিক কনটেন্টের যাত্রাও শুরু করে এ প্ল্যাটফর্মটি। বঙ্গ বিডি যাত্রার পর এক দশক পার হয়েছে। এর মধ্যে বাজারে এসেছে বায়োস্কোপ, চরকি, বিঙ্গে, হইচই সহ এক ডজনেরও বেশী ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। উন্নতমানের কনটেন্ট এবং গ্রাহক চাহিদা পূরণের পরও দেশে টেলিভিশনের আধিপত্য কমাতে পারেনি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। উল্টো গত এক দশকে দেশে টেলিভিশনের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। সরকারের সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে এ তথ্য ওঠে আসে। 

https://youtu.be/j5SVrfE3rtE?si=UNrWlNjgMETQWHM9


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে টেলিভিশন ব্যবহারকারীর অনুপাত ছিলো ৬২। যা এক দশক আগে ২০১৩ সালে ছিলো ৪৬। এ সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনসংখ্যার অনুপাত ছিলো ৪ দশমিক ৮ এবং ২০২২ সালে এসে যা দাঁড়ায় ৩৮ দশমিক ১ এ। ২০১৩ সালে সেলুলার ৮৭ দশমিক ৭ এবং ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৯৭ দশমিক ৪। এ সময়ে ল্যান্ডফোনের ব্যবহার কমেছে ২ দশমিক ৭। ২০১৩ সালে ৩ দশমিক ১ থাকলেও ২০২২ সালে তা দশমিক ৮ এ দাঁড়ায়। 
বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে মোট টেলিভিশন ব্যবহারকারী ছিলো ২ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার ৯৬২ জন। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় টেলিভিশন ব্যবহার করে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৭ জন। আর শহর এলাকায় টেলিভিশন ব্যবহার করে ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৫ জন। ২ কোটি ৬১ লাখ নাগরিক টেলিভিশন ব্যবহার করলেও তার বিপরীতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ ২ হাজার ৯৯২ জন। এর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরো কম। সারাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৬ জন।  
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনপ্রিয়তা, মানসম্মত এবং বিনোদনের রুচিশীল কন্টেন্টের জন্য সকলের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেয় প্লাটফর্মগুলো। বাঁধাধরা সময়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে, নিজের পছন্দের অনুষ্ঠান পর্বটি যখন তখন দেখার সুবিধাই ওটিটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে আশানুরুপভাবে। সবচেয়ে বড় সুবিধা এখানে বিজ্ঞাপন ছাড়াই পছন্দের কন্টেন্ট দেখা যায়। বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর বিস্তারের কারণে এখানে বিনিয়োগ যেমন হচ্ছে, তেমনি উঠে আসছে নতুন নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিচালক, অভিনয় শিল্পী, দর্শকরাও আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ছে চরকি, টফি, বিঞ্জ, বঙ্গ, বায়োস্কোপের মতো দেশীয় ওটিটিতে। তবে এখন শুধু বিনোদন নয়, এমনকি সংবাদ মাধ্যমগুলোও ওটিটিতে নিজেদের পথচলা শুরু করেছে। 
তারা বলছেন, অতীতে সংবাদ, বিনোদন, শিক্ষামূলক অবসর সময় কাটানোর একচ্ছত্র জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। একটা সময় পরিবারের সবাই একসাথে বসে টিভিতে যা দেখাত বসে বসে তাই দেখতে হত। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপক বিস্তৃতি টেলিভিশনের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। তবে এ সময়ে টেলিভিশন বিক্রি এবং ব্যবহার না কমা ইতিবাচক ইন্ডাস্ট্রির জন্য। 
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, আনুপাতিক হারে গৃহভিত্তিক টেলিভিশন ব্যবহার বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৬ ভাগ। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, চরকির মতো প্ল্যাটফর্মের দৌরাত্ম্যে রেডিও-টেলিভিশনের ব্যবহার ব্যাপক কমে যাবে। বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। গেল এক দশকে মোটে সিকিভাগ কমেছে রেডিওর ব্যবহার। ২০১৩ সালে যেটা ছিল ১৩ দশমিক ৯ ভাগ, এখন তা ১২ দশমিক ৮ ভাগ। 
বিবিএস বলছে, বিবিএস প্রথমবারের মতো জেলা ভিত্তিক "ব্যক্তি ও খানা পর্যায়ে জেলাভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ ও প্রয়োগ পরিমাপ” শীর্ষক জরিপ পরিচালনা করেছে। এ জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য হতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সূচক সমূহের অগ্রগতি জানা যাবে। পাশাপাশি জেলাভিত্তিক ব্যক্তি এবং খানাসমূহের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট তথ্যের মাধ্যমে এ খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হবে।
সর্বশেষ জরিপে তথ্যপ্রযুক্তির সরঞ্জামাদি ও এর সার্ভিসের ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, ৫ বছরের বেশী বয়সীরা সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। এর হার প্রায় ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বিপরীতে ল্যান্ডফোন ব্যবহারের চাহিদা সবচেয়ে কমে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া কম্পিউটার ব্যবহার করছে ৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ। গ্রাম পর্যায় এবং শহরগুলোতে পৃথকভাবে জরিপে দেখা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে স্মার্ট ফোন এবং সাধারণ মোবাইলগুলো।
টেলিভিশনের গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির এমন অনভিপ্রেত কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ক্লাউড সিস্টেম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোস্তফা মাহমুদ হোসাইন আজকের বাংলাকে বলেন, আগে টেলিভিশন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিটিসিএলের সংযোগ লাইন ব্যবহার করা হত, যা দেশের সব জায়গায় সহজলভ্য ছিল না। কিন্ত গত এক দশকে সারাদেশে ক্যাবল নেটওয়ার্ক অপারেটররা টেলিভিশন সংযোগের জন্য কাজ করছে। অপারেটরদের এ উদ্যোগের কারণে টেলিভিশন ব্যবহার বেড়েছে। এখন প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে টেলিভিশনের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও ডিটিএইচ অপারেটর আকাশ টিভি দেশের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। যার কারণে দেশের প্রান্তিক পর্যায়েও টেলিভিশনের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও টেলিভিশনেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে বৈকি। মানুষ এখন টেলিভিশনেই ওটিটি প্লাটফর্মের কন্টেন্ট দেখছে। যার কারণে টেলিভিশনের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এটি আগামীতে আরো বাড়তে পারে। 
দেশে কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ওটিটি প্লাটফর্মগুলো। ২০২১ সালে ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়। তবে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও ওই খসড়া নীতিমালা আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে কোনো আইন, নীতিমালা বা গাইডলাইন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করছে ওটিটি প্লাটফর্মগুলো। 
বর্তমানে দেশে প্রচলিত জনপ্রিয় ওটিটি প্লাটফর্মের মধ্যে শীর্ষে আছে বঙ্গ। সুলভমূল্যে নূন্যতম এক সপ্তাহের জন্যও বঙ্গ থেকে গ্রাহকসেবা নিতে পারেন দর্শকরা। এছাড়া অনেক কন্টেন্টই দর্শকদের জন্য ফ্রিতে দেখার সুযোগ দিচ্ছে এই প্লাটফর্মটি। গ্রামণীফোনের সত্ত্বাধিকারী বায়স্কোপ বিনোদন কন্টেন্টের পাশাপাশি দেশি বেদেশি চ্যানেকগুলো দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনকি বায়স্কোপে অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেল ২৪ ঘন্টা সম্প্রচারিত হয়। ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করা রবি এবং এয়ারটেলের ওটিটি 'বিঞ্জ' ১৪০ টিরও বেশি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করছে তাদের প্লাটফর্মে। এছাড়া দিনে মাত্র ২ টাকা ৬৭ পয়সায় বিঞ্জের জনপ্রিয় কন্টেন্টগুলোও দেখতে পারবে গ্রাহকরা। জাগোটিভি আরেকটি জনপ্রিয় ওটিটি যেখানে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো দেখার পাশাপাশি রেডিও স্টেশনও শুনতে পাবে গ্রাহকরা। দেশব্যাপী সাড়াজাগানিয়া কন্টেন্ট পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছি আরেক ওটিটি চরকি। সিনেমা, নাটক, ওয়েব সিরিজে এখন সকলের পছন্দের জনপ্রিয় মাধ্যম চরকি। এছাড়াও দীপ্তপ্লে, সিনেস্পট, টেলিফ্লিক্স, বাংলাফ্লিক্সের মতো বেশকিছু ওটিটি প্লাটফর্ম সমান্তরালভাবে মানুষের বিনোদনে চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে