বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ
নাজমুল হাসান পুলক প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০২:০২ পিএম
স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে বাংলাদেশে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন বলে কথিত রয়েছে। স্বাধীনতার পর তৎকালীন একমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরে অনুষ্ঠিত অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীও তিনি ছিলেন বলা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বে ও পরে তুমুল জনপ্রিয় এ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একসময় নিরবে-নিভৃতে দিন কাটান, ছিটকে পড়েন রাজনীতি থেকে।
বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের আরেকজন ছিলেন ইলিয়াস আলী। ১৯৮০ সালে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৮৭ সালে যে নয় ছাত্রনেতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেন এরশাদ, তাদের মধ্যে ইলিয়াস আলী অন্যতম ছিলেন। রাজনৈতিক পালাবদলে এ জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বিএনপির বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ২০১০ সালে নির্বাচিত হয়ে হরতাল, সাধারণ ধর্মঘট থেকে শুরু করে প্রতিরোধ কর্মসূচী, বিক্ষোভ এবং দলগঠন সহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সমন্বয় সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন। এরই মধ্যে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে তাকে গুম করা হয়। এরপর আর দেখা মেলেনি তুমুল জনপ্রিয় এ নেতার। বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত ইতিহাস বলছে, তুমুল জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছিলেন। যারা হত্যার শিকার হননি তাদের অনেকেই রাজনীতি থেকে আড়ালে চলে গিয়েছিলেন অথবা ছিটকে পড়েছেন রাজনীতির মঞ্চ থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনির হাতে ক্রসফায়ারের শিকারদের একজন সিরাজ শিকদার। একাত্তর এর পর সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করে ‘পূর্ব বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল হাজির করেন।
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে তিনি আত্মগোপন করেন। কী অবস্থায় সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে শেষপর্যন্ত আটক হন, এবং ঠিক কখন, কোথায়, কীভাবে তাকে নির্বিচার হত্যা করা হয়-সে সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে।
২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে পাওয়া পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত আত্মগোপনকারী চরমপন্থী দলের নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ গত ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার করে। সেই দিনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেন এবং তার দলীয় কর্মীদের কিছু গোপন আস্তানা এবং গোলাবারুদ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের সাথে যেতে সম্মত হন। তদানুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একদল পুলিশ যখন তাকে পুলিশ ভ্যানে করে গোপন আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন তিনি সাভারের কাছে পুলিশের ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পুলিশ তার পলায়ন রোধের জন্য গুলিবর্ষণ করে। ফলে সিরাজ সিকদারের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জনপ্রিয় নেতাদের অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছিলেন। চারজন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ মনসুর আলী ও আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এমন উদাহরণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদ নিজেকে রাষ্টপতির পদে আসীন করে সামরিক শাসন জারি করে ও ২২শে আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়। ২ মাস ১৯ দিন পর একই বছরের ৩ নভেম্বর গভীর রাতে সেনাসদস্যরা দেশত্যাগ করার পূর্বে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ এর অনুমতি নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সেখানে বন্দি অবস্থায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
যারাই দীর্ঘকাল রাজনীতির বাইরে ছিলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তারা আর ফিরতে পারেনি রাজনীতির মাঠে। এমনই উদাহরণ আশির দশকের দুই ডাকসাইটে ছাত্রদল নেতা সানাউল হক নীরু ও গোলাম ফারুক অভি। স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন তারা। ছাত্রদলের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন রাজপথ কাঁপানো দুই ছাত্রনেতা অভি-নীরু। ভালো সংগঠক হিসেবে তাদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তবে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনের চাপের মুখে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয় অভি ও নীরুকে।
জনমনে এখন প্রশ্ন, বিএনপির একসময়কার জনপ্রিয় নেতা, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী? ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো নেত্রকোনা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মি. বাবর। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০০১ সালে লুৎফুজ্জামান বাবর নেত্রকোনার একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে বছর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বাংলাদেশে সরকার গঠন করার পর যে কয়েকজন ব্যক্তি প্রবলভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন, তাদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর ছিলেন অন্যতম।
চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় অস্ত্র আইনে করা মামলায় ১৭ বছর জেল খাটার পর সম্প্রতি কারামুক্ত হয়েছেন তিনি। কিছুদিন আগেও ওমরাহ করতে যাওয়ার পথে উড়োজাহাজে শ্বাসকষ্টে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আপাতত তাকে দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সামনের সময়গুলোতেও রাজনীতিতে তার ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
হত্যার শিকার হয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও। রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে পারেন নি অনেকেই, এদের কেও হঠাত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন, কেও বা খুন হন আততায়ীর হাতে।
দীর্ঘদিনের জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করার পর, শারিরিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন লুৎফুজ্জামান বাবর। তাই সুদুর ভবিষ্যতে তাকে রাজনীতিতে দেখা যেতে পারে কীনা তা নিয়েই কথা বলছেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে যদি সে রাজনীতিতে ফেরেও, আগের মত কতটা প্রভাব তিনি রাখতে পারবেন সেটি নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
জানতে চাইলে রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য এমনটা নতুন নয়। প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হন অনেক রাজনীতিবিদই। অনেকে হয়তো বেশিদিনের জন্য জেল-জুলুমের শিকার হন। সেক্ষেত্রে লুৎফুজ্জামান বাবরের শারীরিক অবস্থা ভালো হলে খুব ভালোভাবেই ফিরে আসবেন বলে আমি মনে করি।