মোহাম্মদ জুনায়েদ প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০২:০২ পিএম
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে চলমান ‘গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’ বর্তমানে দুর্নীতি, ঘুষ, অবৈধ লেনদেন, সনদ জালিয়াতি, নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানি এবং কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার মতো নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রকল্পটির অধীনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারা সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ, সম্পদ এবং পদমর্যাদার অপব্যবহার করছেন, যার ফলে দেশের জনগণের জন্য বরাদ্দ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
হিসাবরক্ষক এবিএম তরিকুল ইসলামের দুর্নীতি : এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের হিসাবরক্ষক এবিএম তরিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছেন। তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি প্রকল্পের সকল স্তরে কমিশন গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, স্কিম অনুমোদনের সময়, দ্বিতীয়ত টেন্ডার অনুমোদন এবং তৃতীয়ত, ফান্ড বরাদ্দের সময়, তিনি মোট ১০% কমিশন গ্রহণ করে থাকেন বলে জানা গেছে।
আগারগাঁও এলজিইডি অফিসের এক কর্মকর্তা দৈনিক আজকের বাংলাকে বলেন, তরিকুল হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করলেও প্রকল্প পরিচালকদের গাড়িতে চলাফেরা করেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কৌশলে জিম্মি করে তিনি কাজ হাসিল করেন। কথা না শুনলে ওপর মহলকে হাত করে তরিকুল প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করান। হেড অফিসের বড় কর্তাদের সঙ্গে তার রয়েছে সখ্য। তরিকুলের বিলাসী জীবনযাপন করার বিষয়টি তার চালচলনেই প্রকাশ পায়। তার হাতের ঘড়িটির দামও কয়েক লাখ টাকা।
জানা যায়, সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রজেক্টের খুচরা মালামাল কিনেছেন তরিকুল। ঘনিষ্ঠ একাধিক ঠিকাদারের মাধ্যমে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ক্রয় সম্পন্ন দেখিয়ে টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, এ ক্ষেত্রে তরিকুল কমপক্ষে ২ শতাংশ নিজের জন্য রাখতেন। ওপরের মহলকে সন্তুষ্ট করেই তিনি এই কাজগুলো করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নগদ ঘুষ গ্রহণের পাশাপাশি গোপন কিছু অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করতেন। ইউসিবি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় তৎকালীন কর্মরত স্ত্রী জাকিয়া পারভীনের মাধ্যমে এই অ্যাকাউন্টগুলো পরিচালনা করতেন। তার স্ত্রী এখন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।
ব্যাংক সূত্র জানায়, হিসাব দুটি হলো মেসার্স রনি এন্টারপ্রাইজ, ইউসিবি ধানমন্ডি ব্রাঞ্চ, অ্যাকাউন্ট নম্বর ০৮৪২১১২০০০০০১১৫৪। অন্যটি মেসার্স রুনা এন্টারপ্রাইজ, ইউসিবি ধানমন্ডি ব্রাঞ্চ, অ্যাকাউন্ট নম্বর ০৮৪২১১০০০০০১৭৬৬। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকের অবৈধ লেনদেন করার জন্য তরিকুলের পক্ষ থেকে নিযুক্ত ব্যক্তি রাকিবুল ইসলাম।
তরিকুল নিজ সিন্ডিকেটের উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবুলের নামেও আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলে অবৈধ লেনদেন পরিচালনা করেছেন। ২০১৯-২২ সময়ে জনতা ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের শাখায় হিসাব নম্বর ০১০০১৪৬০৩৪৭৩৪ অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। লেনদেনের খবর মৌখিকভাবে জানাজানি হলে হিসাবটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি নিজের দুর্নীতির খবর দেখে তরিকুল সতর্ক হয়ে যান। অফিসে দুজন অফিস সহায়ক থাকলেও তরিকুল গোপন কাজ পরিচালনার জন্য মাসে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চু নামের এক যুবককে নিয়োগ করেছেন। বর্তমানে সেই তার ঘুষের টাকার লেনদেন করছেন।
দুদকের একজন উপপরিচালক অবৈধ সম্পদের তথ্য নিশ্চিত করে দৈনিক আজকের বাংলাকে বলেছেন, ‘তরিকুলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। এটা শেষ হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।’ তিনি বলেন,‘আমাদের টিম তার গ্রামের বাড়ি আগড়ায় গিয়ে অনুসন্ধানের কাজ চলমান রেখেছে।’
উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ : এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানি এবং মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়, তিনি কর্মস্থলে নারীদের নানা রকমের অসদাচরণ এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছেন। নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানি এবং তাদের উপর মানসিক অত্যাচারের ঘটনায় প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা রহস্যজনকভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাকে রাঙামাটিতে বদলি করা হলেও, তার ক্ষমতার প্রভাবে বদলির আদেশ বাতিল হয়ে যায় এবং তিনি পূর্ববর্তী কর্মস্থলে অবস্থান করেন। এই ঘটনাগুলো এলজিইডির কর্তৃপক্ষের নজরেও আসলেও তাদের কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রাকিবুল ইসলামের অবৈধ অর্থ সংগ্রহ : উক্ত প্রকল্পের মো: রাকিবুল ইসলাম, যিনি সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত আছেন। যিনি সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো: মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। উপ সহকারি প্রকৌশলী (আউটসোর্সিং) থাকা অবস্থায় ২ টি পৌরসভা থেকে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে সংগ্রহ করে। পরবতীতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে হিসাব বন্ধ করে দেয়। আউটসোর্সিং বিধিমালা ২০১৮ এর বিধান অনুযায়ী কোথাও লোক নিয়োগ দিতে হলো দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করে তৃতীয় পক্ষ ঠিকাদার থেকে লোক নিয়োগ দেওয়ার কথা। রাকিবের ক্ষেত্রে হিসাব রক্ষক এবং পিডি অফিসিয়াল নোট দিয়ে এলজিইডির এলকেএসএস কে নিয়োগ দিতে বলে যা সম্পূর্ন অবৈধ।
তাহসিনা আক্তারের সার্টিফিকেট জালিয়াতি : প্রকল্পে চাকরিরত এক প্রকৌলশী সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে নিজেকে ‘বড় প্রকৌশলী’ দাবী করেন। ওই নারী প্রকৌশলীর নাম তাহসিনা আক্তার। তিনি এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকরি করে আসছেন। যদিও এলজিইডির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানলেও তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
তথ্যমতে, এলজিইডির নিয়োগ বিধিমালা-২০০৯ অনুযায়ী একজন উপসহকারী প্রকৌশলীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার কথা ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রকৌশলীর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমন প্রতারণা করে চাকরিতে যোগ দেন। আর তাকে এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
সম্প্রতি দৈনিক আজকের বাংলার কাছে প্রকৌশলী তাহসিনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ এসেছে। সেখানে তার জাল-জালিয়াতির বেশ কিছু তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। এরপরই বের হয়ে আসে প্রকৌশলী তাহসিনার প্রতারণার বিভিন্ন বিষয়।
এলজিইডির সূত্র জানায়, তাহসিনা আক্তার ১৯৯৪ সালে বরিশাল পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করছে। তার রোল নং-১০৩১, রেজিস্ট্রেশন নং এবং ২২৪৩ সার্টিফিকেট সিরিয়াল ০০২৮৫১২। ইলেকট্রিক্যাল ডিপ্লোমা করলেও ওই সার্টিফিকেট নকল করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তৈরি করেন। জানা যায়, এলজিইডির প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তার জন্মগ্রহণ করছেন ১-১১-১৯৭৭ সালে। আর ডিপ্লোমা শেষ করছে ১৯৯৪ সালে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে কীভাবে এসএসসি এবং তিন বছরের ডিপ্লোমা শেষ করলেন তিনি- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে? অনেকেই বলছেন, তিনি জাল-জালিয়াতি এবং ওপরের কাউকে ম্যানেজ অবৈধপথে চাকরিতে যোগ দেন।
জানা যায়, এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তার ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকরি করছেন। তা ছাড়া তিনি নারী হওয়ার সুবাদে সবকিছু ম্যানেজ করে উপসহকারী প্রকৌশলীদের সিনিয়রিটি তালিকায় সিরিয়াল ৬৯৪, শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পদে এগিয়ে আছেন।
তথ্যমতে, তাহসিনার প্রতারণার ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সবাই জানলেও এখনো গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত। জানা যায়, তার মামা ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. লুৎফর রহমান। পতিত স্বৈরাচারের দোসর।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রকৌশলী তাহসিনা বরিশালের সাবেক ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাফিয়া ডন মিরাজুল ইসলামের সহযোগিতায় এবং এ প্রকল্প পরিচালক মো. সুজায়েত হোসেনের হাত দিয়ে নিয়োগ পান। তা ছাড়া প্রকল্প পরিচালক সুজায়েত হোসেনের হাত দিয়ে তিনি বিভিন্ন অকর্ম করে আসছেন।
পিডি সুজায়েত হোসেনের নেতৃত্বে সিন্ডিকেটের অভিযোগ: প্রকল্পটির পিডি (প্রকল্প পরিচালক) সুজায়েত হোসেনের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ, টেন্ডার এবং ফান্ড বিতরণ প্রক্রিয়ায় অবৈধ লেনদেন ও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এই সিন্ডিকেটটি প্রকল্পের প্রকৃত উন্নয়ন কাজে বাধা সৃষ্টি করে অনৈতিক উপায়ে আকাশছোঁয়া সম্পদের মালিক হয়েছেন কর্মকর্তারা।
এই প্রকল্পের কর্মকর্তারা একে অপরের সহায়তায় অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করে প্রকল্পের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পের পরিচালনায় থাকা অনেক কর্মকর্তার এই দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেন সম্পর্কে এলজিইডির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জানা থাকলেও, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই কর্মকর্তা-সংশ্লিষ্ট সবাই তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করছেন।
এবিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক গোলাম সারোয়ার অনিক দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, দুদকের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এবিষয়ে রাষ্ট্র সংস্কার ফোরামের সমন্বয়কারী নুরুল কাদের সোহেল দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, দেশের দুর্নীতিবাজদেরকে বিচারের আওতায় না আনলে রাষ্ট্র কখনো সংস্কার হবে না। সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তারমধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।