শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫
logo

অস্পৃশ্য থেকে রাজনীতিতে দলিত-হরিজন সম্প্রদায়


মিরহাজুল শিবলী প্রকাশিত:  ০৫ মার্চ, ২০২৫, ০১:০৩ এএম

অস্পৃশ্য থেকে রাজনীতিতে দলিত-হরিজন সম্প্রদায়

 



 


সমাজে তারা অচ্ছুৎ। একটি নির্ধারিত সীমানার মধ্যে তাদের নিজস্ব সমাজ, যেন সম্পর্কহীন বাহিরের ঝলমলে চকচকে দুনিয়ার সাথে। জীবন এখানেই সীমাবদ্ধ। যেন নেই নতুন কোন আশা। কোনমতে কোন একটা সুইপারের চাকরি হলেই যেন জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। এরকমই চিরায়ত জীবন ছিলো দেশের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের। তবে সেই অস্পৃশ্যতার চক্রবুহ্য ভেঙে বাংলাদেশে প্রথম মূলধারার রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।  
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের যুগ্ম সদস্য সচিব মোল্লা ফারুক এহসান, যুগ্ম মূখ্য সমন্বয়ক ভীম্পাল্লি ডেভিড রাজু ও কৈলাশ চন্দ্র রবি দাসের নেতৃত্বে হরিজন সম্প্রদায়ের কয়েকশো মানুষ যোগ দেয়। এসময় তারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত প্ল্যাকার্ড তারা তুলে ধরেন। সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।  
হরিজন সম্প্রদায়ের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালি দলিতদের সাধারণভাবে হরিজন বলা হয়। মুচি, ডোম, বাল্মিকী, রবিদাস, ডোমার, ডালু, মালা, হেলা, বাঁশফোর, পাহান, লালবেগী, সাচ্চারি প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের এক সুন্দর নাম হরিজন। ব্রিটিশ শাসনামলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, চা-বাগানের কাজ, জঙ্গল কাটা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের সহ নানা অঞ্চল থেকে দরিদ্র দলিত মানুষকে এ দেশে আনা হয়। তাদের থাকতে দেওয়া হয় কাজের জায়গায়, কলোনিতে। রাস্তা-ঘাট, বাজার, রেস্তোরাঁ, রেলের কামরা, স্কুল–কলেজ পরিষ্কার করবে এরা। আবার কামার, কুমার, চর্মকার, জেলে, রজদাস, ক্ষৌরকার প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষকে বাঙালি দলিত আখ্যা দেওয়া হয়। তবে শত বছর ধরে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এদের কাছ থেকে সেবা নেওয়া যাবে, কিন্তু ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। অথচ তারা ময়লা নয়, তারাই পরিচ্ছন্নতার দূত।  
সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ লাখ হাজার দলিত জনগোষ্ঠী, ১২ লাখ ৮৫ হাজার হরিজন জনগোষ্ঠী রয়েছে। এসব দলিত হরিজনদের জন্য যেন জন্ম আর কর্ম এক সুতোয় বাঁধা। তাই এই সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই বংশপরম্পরায় অভিন্ন পেশায় নিয়োজিত।  
হরিজন ও রাজনীতি:
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে হরিজন সম্প্রদায় একটি পুরোনো ভোট ব্যাংক। ১৯৩২ সালে দলিত নেতা বি আর আম্বেদকারের প্রচেষ্টায় নতুন সংবিধানের আওতায় অস্পৃশ্যদের জন্য আলাদা ভোট ব্যবস্থা রাখা হয়। গান্ধী তা মানতে চাইলেন না। প্রতিবাদে সে বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি অনশনে বসে যান। সারা দেশের কোটি কোটি দলিত যদি আলাদা নির্বাচন করে, তাহলে কংগ্রেসের শক্তিতে টান পড়তে বাধ্য। তাতে ভোটের পাল্লা মুসলিম লীগের দিকে ঝুঁকতে কতক্ষণ? তাই সমাজে অচ্ছুত হলেও রাজনীতিতে তাদের অচ্ছুত রাখা যাবে না। ডাক পড়ল ভুবন জয়ী দলিত ক্রিকেটার পালওয়াঙ্কার বালুর। বালুর মধ্যস্থতায় ছয় দিন পর অনশন ভাঙেন গান্ধীজি। সমাজের তথাকথিত এসব অচ্ছুৎ মানুষকে মহাত্মা গান্ধী নাম দেন হরিজন বা ঈশ্বরের সন্তান। 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো হরিজনদের নিয়ে আলাদাভাবে মাতামাতি হয়নি। কখনো বৃহৎ পরিসরে তাদের যুক্ত করার মানসিকতাও দেখায় নি কোন রাজনৈতিক দল। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি ভেঙে দিয়েছে সেই ট্যাবু। সরাসরি কেন্দ্রীয় কমিটিতে হরিজনদের অন্তর্ভুক্ত করেছে এনসিপি। যুগ্ম মূখ্য সমন্বয়ক পদে দায়িত্ব পেয়েছেন হরিজন সম্প্রদায়ের দুইজন সদস্য ভীম্পাল্লি ডেভিড রাজু ও কৈলাশ চন্দ্র রবি দাস। তবে কি আসন্ন নির্বাচনে প্রায় ৬০ লাখ হরিজন-দলিত সম্প্রদায়ের ভোট ব্যাংক হাওয়া দিচ্ছে নাগরিক পার্টির পালে?
নবগঠিত কমিটির নেতা কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস আজকের বাংলাকে বলেন, হরিজন, দলিত ও তফশীলি সম্প্রদায়ের মানুষগুলো ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত। রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্য অধিকারের ছোট অংশটিও পায় না এ সম্প্রদায়ের মানুষের থেকে তারা যা পায়, তা অধিকারের জায়গা থেকে পায় না। পায় করুণার জায়গা থেকে। এসব সম্প্রদায়ের মানুষের শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব থাকায় তারা প্রাপ্যতা বুঝে নিতে পারে না। এবার আমরা মূলধারার রাজনীতিতে সুযোগ পেয়েছি। বঞ্চিত এই মানুষগুলোর জন্য আমরা কাজ করে যাবো।  
হাজারীবাগের হরিজন পল্লীতে দীর্ঘদিন বসবাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিল্লাল ও কানাইলাল। আজকের বাংলার এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তাদের। বিল্লাল জানান, সমাজ তো আমাদের তো মানুষই মনে করে না। আমাদের সাথে তো কেউ এক কাপ চা ও খায় না। ছাত্রদের দলে যে আমাদের জাতের লোককে পদ দিয়েছে এটা তো বিরাট ব্যাপার। আমরা অনেক খুশি যে তারা আমাদের অন্য সবার মত মানুষ মনে করছে। কানাইলাল জানায়, আমরা অনেক খুশি, ঐ বড় বড় নেতাদের সাথে আমাদের লোকও থাকবে!  
উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে দলিত, হরিজন সম্প্রদায়ের বড় সংখ্যক মানুষ রয়েছে। ভারতের সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ১৫ তম জনশুমারী- ২০১১ অনুযায়ী, দেশটির দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ২০ কোটি যা মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ হিন্দু হলেও তার ৭০-৭৫ শতাংশ মানুষই দলিত সম্প্রদায়ের। উপমহাদেশের আরেক দেশ নেপালের জনশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ দলিত যা সংখ্যায় প্রায় ৩৬ লাখ। দলিতদের অধিকার রক্ষার সংগঠন আইডিএসএন এর তথ্যমতে, শ্রীলঙ্কায় অন্তত ৪০ থেকে ৫০ লাখ দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে।  
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলিতরা নতুন হলেও ভারতে রাজনীতি সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার নজির রয়েছে। ১৯৫০ এর দশকে ভারতের দলিতরা রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালে বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) গঠিত হলে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে দলিতরা শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে শুরু করে। এছাড়াও রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়া (আরপিআই), সাম্যবাদী পার্টি (এসপি) দলিত পন্থার রাজনীতি করে থাকে। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার নজিরও রয়েছে। দেশটির প্রাক্তন দুই রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং কে আর নারায়ণন একজন দলিত ছিলেন। ভারতীয় সংবিধান রচয়িতা ড. বি আর আম্বেদকর দলিতদের প্রধান নেতা ছিলেন। এছাড়াও ভারতীয় সেনা প্রধান পদেও ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে দলিতদের বড় প্রভাব রয়েছে। প্রদেশটির চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী, বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জিতন রাম মাঝি ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চান্নি দলিত ছিলেন। 
নেপালের রাজনীতিতেও ধীরে ধীরে দলিতদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ইতোমধ্যে দেশটির সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদে দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। আবার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গাওপালিকা ও নগরপালিকায়ও দলিতদের জন্য সংরক্ষিত কোটা রয়েছে। দলিত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে দেশটির মন্ত্রী হিসেবে জীবন রাই এবং বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে গঙ্গা প্রসাদ তিমলসিনা দায়িত্ব পালন করার নজির স্থাপন করেছেন।  
শ্রীলঙ্কায় দলিতরা ভারত কিংবা নেপালের মত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নয়। দেশটিতে মূলধারার রাজনীতিতে দলিতদের সরাসরি রাজনৈতিক পরিচয় নেই। শ্রীলঙ্কায় মূলত চা চাষ করার কাজে ব্রিটিশরা তামিল থেকে নিয়ে যায়। পার্লামেন্টে ভারতীয় তামিলদের জন্য বেশ কিছু আসন সংরক্ষিত থাকলেও সেগুলো মূলত শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে প্রতিনিধিত্ব করে।  
পাকিস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দলিতদের কোন সংরক্ষিত আসন নেই। তবে সংখ্যালঘু সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে দলিতরা সুযোগ পায়। দেশটির হিন্দু জনগোষ্ঠীর ৭০-৭৫% মানুষ দলিত। কৃষ্ণ কুমার কোহলি পাকিস্তানের প্রথম দলিত হিন্দু সিনেটর। এছাড়াও সিন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য রাম নাথ মেঘওয়াল এবং জাতীয় পরিষদের সদস্য গিয়ান চাঁদ মেঘওয়াল দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য। দেশটির দলিতদের বেশিরভাগ পাকিস্তান পিপলস পার্টির সদস্য।