ইমরান নাফিস প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল, ২০২৫, ০১:০৪ এএম
দেশজুড়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারী উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস ফর প্রোগ্রামড অ্যাকশন (উদ্দীপন)। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমও রয়েছে তাদের। গণঅভ্যুত্থানের পর সংস্থাটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে সংস্থাটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৬৯ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার ৪০৩ টাকা।
উদ্দীপনের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, তবে নতুন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের আগে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৮০ কোটি টাকা। যা গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত তিন মাসে সংস্থাটির ১৮৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রশাসক বসার পর থেকে উদ্দীপনের অনেক কর্মকাণ্ড থমকে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণের অনেক কিস্তি পরিশোধ করেনি গ্রাহকরা। প্রশাসকের কার্যকারিতা না থাকা, নিয়মিত অফিসে না আসা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) অনুপস্থিতির কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উদ্দীপনে। প্রশাসক স্বচ্ছ নির্বাচন না করে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে উদ্দীপনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার অধীনে বন্ধ হয়ে গেছে সংস্থার বহু সেবামূলক প্রকল্প, যা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গত বছরের ২৮ নভেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত এই সচিবকে উদ্দীপনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপত্রে দায়িত্বভার গ্রহণ, সংস্থা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন এবং নির্বাচিতদের কাছে দ্রুততার সঙ্গে দায়িত্ব হস্তান্তরের মতো বিষয়গুলোকে তার কর্মপরিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে সংস্থার অনিয়ম ও কুশাসনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে প্রশাসকের মেয়াদ ৯০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৫০ দিন করার অনুরোধ করেন বর্তমান প্রশাসক। আবেদনের যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আজ অবধি উদ্দীপনের কার্যক্রমে কোনো গতি আনতে পারেননি তিনি। শুধু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের দিকে তাকালেই এ চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে সংস্থাটিতে ঋণ খেলাপি এখন নিত্যদিনের চিত্র।
উদ্দীপনের সাবেক কনসালট্যান্ট মো. কামরুজ্জামান কামরুল দৈনিক আজকের বাংলাকে বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়। এসব লেনদেনের অধিকাংশই মানবসম্পদ বিভাগের উপপরিচালক মনির হোসেন ও তার সহযোগীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর ফলে ঋণ খেলাপি দিন দিন বেড়েই চলছে। গত তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৬৯ কোটি টাকা। ঋণের নামে লুট হচ্ছে লাখ লাখ টাকা, যা কেবল প্রশাসকের অদূরদর্শিতা ও অব্যবস্থাপনার ফল। এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবসম্পদ বিভাগের উপপরিচালক সৈয়দ মনির হোসেন ও তার সহযোগীরা ৫ আগস্টের পর থেকেই হিংস্র আচরণ করতে শুরু করেন। সংস্থার সব ক্ষেত্রেই তার অনধিকারচর্চা বেড়েছে। এ বিষয়ে প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।’
এদিকে, উদ্দীপনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিদ্যুৎ কুমার বসুকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। সিইওর অনুপস্থিতিও সংস্থাটির কার্যক্রমে ধীর গতি এনেছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আদাবর এলাকার সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে। এতে নেতৃত্ব দেন মানবসম্পদ বিভাগের উপপরিচালক সৈয়দ মনির হোসেন।
কর্মকর্তারা জানান, ওই দিন সকাল ১১টার দিকে অফিসে পৌঁছালে গেটেই তাকে আটকে দেওয়া হয়। পরে অফিসে প্রবেশের অনুমতি মিললেও নিজ কক্ষে যেতে দেওয়া হয়নি। এরপর মানবসম্পদ বিভাগে নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে রেখে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। এমনকি তার ব্যক্তিগত গাড়ির চাবিও নিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ঘটনার সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি।
প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের তদন্ত করা হয়নি। একই সঙ্গে কোনো ধরনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। অথচ অনিয়মের কারণেই তিনি নির্ধারিত মেয়াদের অতিরিক্ত ৬০ দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে কামরুজ্জামান বলেন, ইতোমধ্যে তিনি সংস্থার নানা অলাভজনক উন্নয়নমূলক প্রকল্প স্থগিত করেছেন—যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সহায়তা, পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম, উন্নয়নমুখী ঋণদান ইত্যাদি। তিনি আরও বলেন, প্রশাসকের এসব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে সংস্থার নীতিবিরুদ্ধ। এতে প্রতিনিয়ত উদ্দীপনের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি দায়িত্বশীল আচরণ করেননি। যেটা উনার কাজ নয় সেটা উনি করেছেন।
প্রশাসক এ এইচ এম নুরুল ইসলাম বর্তমানে বর্ধিত মেয়াদের শেষ প্রান্তে অবস্থান করছেন। কিন্তু কর্মপরিধির বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আজকের বাংলাকে বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুতই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেব। সংস্থার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন-পরবর্তী দায়িত্ব হস্তান্তরে এক মিনিটও দেরি করব না।’
এদিকে, নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য ২১ দিন সময় প্রয়োজন হয়। আজ থেকেই সেই ২১ দিনের সময় গণনা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসক কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা যায়নি।
এ এইচ এম নুরুল ইসলামের কর্মজীবনের শুরুতে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সুনাম থাকলেও সময়ের সঙ্গে তার কিছু বিতর্কিত ভূমিকা তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) পদে থাকা অবস্থায় প্রশাসনে দলীয়করণ, পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগ ও বিভিন্ন ফাইল অনুমোদনে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ওঠে।
অবসরের পর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগ পাওয়া তার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যই বড় ভূমিকা রেখেছে কিনা। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)-এর বোর্ড চেয়ারম্যান পদেও তার অবস্থানকে অনেকে সরকারের ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের অংশ হিসেবে দেখেন, যেখানে তদবির আর সাবেক রাজনৈতিক পরিচিতি মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে উদ্দীপন এনজিওর প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আরেক দফা অভিযোগ উঠে—সংস্থার নিয়মিত নির্বাচন না করে দীর্ঘ সময় নিজেই নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা, সেবামূলক কার্যক্রম স্থগিত করে উন্নয়ন ব্যাহত করা, এবং পূর্বের বিতর্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকিয়ে রাখা। সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে উদ্দীপনের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার দায়ও তার দিকেই নির্দেশ করে। নুরুল ইসলামের প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি দলীয় পক্ষপাত, অস্বচ্ছ নেতৃত্ব ও দায়িত্বে থেকেও নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ তার ভাবমূর্তিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।