রাফসান জাহান প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর, ২০২৪, ০৫:১১ পিএম
কুমিল্লার বরুড়ায় আওয়ামীপন্থি ৭ ইউপি চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসন করেছে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন। গত ১৭ নভেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বরুড়া উপজেলার ভবানীপুর, খোশবাস দক্ষিণ, ঝলম, চিতড্ডা, আড্ডা, লক্ষ্মীপুর ও পয়ালগাছা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে স্বপদে বহাল করা হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। স্বপদে পুনর্বহাল হওয়া চেয়ারম্যানরা হলেন- ২নং ভবানীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান (বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং ভবানীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), ৪নং দক্ষিণ খোশবাস ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী মো. আবদুর রব (নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী), ৫নং ঝলম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু (সাবেক সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ), ৬নং চিতড্ডা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাকারিয়া (নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী), ১২নং আড্ডা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান (ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), ১৪নং লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হাসেম (নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী) এবং ১৫নং পয়ালগাছা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ মহি উদ্দিন (নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী)। ইতিপূর্বে শিলমুড়ি (উ:) ইউনিয়ন, শিলমুড়ি (দ:) ইউনিয়ন, গালিমপুর ইউনিয়ন ও ভাউকসার ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগপন্থি চেয়ারম্যানদের স্বপদে বহাল করা হয়েছে।
আলোচিত অফিস আদেশ সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউপি-১ শাখা এর ২৭.১০.২০২৪ তারিখের ৪৬.০০.০০০০.০০০.০১৭.৯৯.০০৪৪.২২-৬৮৪ নম্বর স্মারকে জারীকৃত সংশোধিত পরিপত্র এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের ০৯.০৯.২০২৪ তারিখের ০৫.৪২.০০০০.০৪১.০২.০১০.২১.৬০৪ নম্বর স্মারকে প্রদত্ত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার ভবানীপুর, খোশবাস দক্ষিণ, ঝলম, চিতড্ডা, আড্ডা, লক্ষ্মীপুর ও পয়ালগাছা ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যানগণের অনুপস্থিতকালীন সময়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্যানেল চেয়ারম্যানগণকে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণপূর্বক এ কার্যালয়ের ০৯.০৯.২০২৪ তারিখের ০৫.২০.১৯০০.০০৯.৪৩.০০৮.২৩-৮৯৩ নম্বর স্মারকে অফিস আদেশ জারি করা হয়। গত ১১.১১.২০২৪ তারিখের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বরুড়া, কুমিল্লার এর ০৫.২০.১৯০৯.০০০.০০৬.০৩.২৪-১১১৯ নম্বর স্মারকে প্রেরিত প্রতিবেদন মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যানগণ ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে উপস্থিত থাকায় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বরুড়া, কুমিল্লা কর্তৃক উক্ত চেয়ারম্যানদের পুনঃদায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ কার্যালয়ের ০৯.০৯.২০২৪ তারিখের ০৫.২০.১৯০০.০০৯.৪৩.০০৮.২৩-৮৯৩ নম্বসর স্মারকে জারিকৃত বরুড়া উপজেলার উল্লিখত ইউনিয়ন পরিষদসমূহের প্যানেল চেয়ারম্যানগণের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা প্রদান সংক্রান্ত প্রযোজ্য অংশ এতদ্বারা বাতিল করা হলো। এতে আলোচ্য ৭ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ স্বপদে বহাল হয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে মানুষকে। একই অবস্থা ছিল কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে। এসব ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগপন্থি চেয়ারম্যানরা আত্মগোপনে ছিলেন। হামলা, মামলার ভয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বরুড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা গাঢাকা দেন। তাদের অনুপস্থিতিতে সেবাদানে স্থবিরতা নেমে আসে।
অভিযোগ উঠেছে, কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগপন্থি চেয়ারম্যানরা স্বপদে ফিরতে মোটা অংকে অর্থ বিনিয়োগ করেন। আর সেটি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ উঠে বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নু-এমং মারমা মং এবং কুমিল্লা জেলার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছারের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বপদে পুনর্বহাল হওয়া আলোচিত ৭ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদধারী নেতা এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে ইউপি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সক্রিয় অংশগ্রহণসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নু-এমং মারমা মং দৈনিক আজকের বাংলাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে আমি এই সাতজনের নাম প্রস্তাব করি। তাদের যাচাই-বাছাই করার আমার কোন এখতিয়ার নেই। যদি কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকে তাহলে সে বিষয়ে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে জেলা প্রশাসক মহোদ্বয়ের সাথেও এ বিষয়ে কথা বলে নেব।’ ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কখনও ছাত্রলীগ করিনি।’
এ ব্যাপারে কুমিল্লা জেলার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছারের মুঠোফোনে বারবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, কোমরে পিস্তল রেখে ভবানীপুর ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের ফুলেল শুভেচ্ছার ছবি ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভাইরাল ওই ছবিতে দুজন ব্যক্তির হাত থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণ করতে দেখা গেছে চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে। এ সময় প্রকাশ্যে কোমরের ডানপাশে প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে পিস্তল। যদিও ওই ইউপি চেয়ারম্যানের দাবি পিস্তলটি লাইসেন্স করা। লাইসেন্স করা হলেও এভাবে প্রদর্শন করা নিয়ে জনমনে নেতিবাচক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ঝলম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নিজ দলের কর্মীর উপর হামলা করার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। নুরুল ইসলাম তার ইচ্ছা মতই ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনা করারও অভিযোগ রয়েছে। সরকার ইউনিয়ন পরিষদে ৭০ ধরণের সেবা প্রদান করে থাকে যার কোনটিই ঝলমবাসী পায় না। ১০ টাকা কেজির চাউল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সেবা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার উপর অমানবিক নির্যাতন করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। কিছু দিন পর পর চেয়ারম্যানের লোকজন বাজারে ঝামেলা সৃষ্টি করে। ১০ টাকা কেজি চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ দিতে উপজেলায় গেলে কয়েকজন বেধড়ক মারধরের শিকার হন।
বরুড়ার পয়ালগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ মহি উদ্দিন মাহিনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিচারের দাবিতে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে মানববন্ধন করেন ইউপিবাসীরা।