আশরাফ আহমেদ , হোসেনপুর প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০২:১২ পিএম
দেশের সাধারণ মানুষ অনেক সময় প্রশাসনের সেবা থেকে বঞ্চিত হন, কারণ তারা ডিঙাতে পারেন না কর্মকর্তাদের অফিসের দরজা। সাধারণদের সরকারি সেবা পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। দিনের পর দিন ঘুরে কাজ করাতে না পেরে মানুষ আস্থা হারাচ্ছে সরকারি অফিস ও অফিসারদের উপর। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছেন।
তেমনই একজন ব্যতিক্রম সরকারি অফিসার অনিন্দ্য মন্ডল, যিনি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।
ভালো কাজ, ভালো ব্যবহার আর ভালোবাসা দিয়ে অনিন্দ্য মন্ডল জয় করে নিয়েছিলেন উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের মন। ক্ষমতাবান মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ দিনমজুর সবার কথা তিনি শোনতেন মনোযোগ সহকারে। সাধারণের জন্য নিজের অফিসের দ্বার অবারিত করে দিয়েছিলেন।
সাধারণত যেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসের দরজা ডিঙাতে না পারায় দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ প্রশাসনের সেবা থেকে বঞ্চিত হন।
আর সেই স্থানে যে কোনো প্রয়োজনে কৃষক, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে কড়া নাড়তো নির্বাহী কর্মকর্তার দরজায়। নিজেদের কষ্টের কথা তারা বলছেন তাদের প্রিয় ইউএনও স্যারের সাথে। যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজন অনুযায়ি সেবা পেয়ে যাচ্ছেন।
হোসেনপুরের শিক্ষার মানোন্নয়নে তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক। শিক্ষকদেরকে উনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। কোন শিক্ষক অফিসে প্রবেশ করলে দাঁড়িয়ে তাকে স্যার সম্বোধন করে, বিনয়ের সহিত বসতে বলতেন। শিক্ষার্থীদেরকে ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব ও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখাতেন। ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যখন হোসেনপুর আসতেন তাদেরকে নিয়ে ঈদ আড্ডা দিতেন। তাদেরকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে দেশ গঠনে ও আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায় এ নিয়ে দিকনির্দেশনা মূলক বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে তাদের মনোবল চাঙ্গা করতেন।
হোসেনপুরে শিশুদের হাসি ফাউন্ডেশনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। শিশুদের মুখে আনন্দ ফুটিয়ে তুলতে উনার ব্যক্তিগত তহবিল ও সরকারি তহবিল থেকে এ ফাউন্ডেশনে অনেক অনুদান দিয়েছেন। ছিন্নমূল গরিব, অসহায় শিশুদের মুখে হাসি থাকে এবং লেখাপড়া করতে পারে এজন্য তিনি ব্যক্তিগত ও সরকারি বিভিন্ন অনুদান দিয়ে এ ফাউন্ডেশনকে সাহায্য করতেন। ছোট শিশু ও শিক্ষার্থীদের প্রতি ওনার আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। প্রায়ই উপজেলার মাঠে ছোট ছোট শিশুদের সাথে খেলায় মেতে উঠতেন। এতে শিশুরা অনেক আনন্দ পেতো। স্কুল পড়ুয়া কিংবা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী রাস্তাঘাটে পেলেই তাদেরকে ডেকে তার লেখাপড়া বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন।
হোসেনপুর মহিলা কলেজে ছাত্রীদেরকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করে তাদেরকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ঐসব ছাত্রীরা যাতে তাদের ভবিষ্যৎ সেই পরিকল্পনা মোতাবেক নিজের জীবনকে গড়তে পারে, সাজাতে পারে এ বিষয়ে বিভিন্ন উৎসাহ উদ্দীপনা যুগিয়েছেন।
হোসেনপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের রাস্তাঘাট, স্কুল- কলেজ, মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমস্যা তড়িৎ সমাধান করতেন। গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে বই দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। লেখাপড়া আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তিনি উপজেলায় মেধাবৃত্তির আয়োজন করেছিলেন।সদ্য এসএসসি পাসকৃত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ক বৃত্তির আয়োজন করে তাদেরকে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর সারা দেশে যখন উদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল, সেই মুহূর্তে উনি হোসেনপুরকে একটি শান্তিনগর হিসেবে গড়ে তোলেন। উনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতার মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদারতায় হোসেনপুরে কোন বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হতে দেননি। সকলকে সাথে নিয়ে উনি সুন্দর একটি পরিবেশ হোসেনপুরে স্থাপন করেছিলেন।
গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের আস্তার প্রতীক ছিলেন তিনি। অসহায় মানুষগুলো তাদের কষ্টের কথাগুলো উনার সাথে মন খুলে বলতে পারতেন। আর তিনি তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে পাশে থাকতেন।
নিজের এমন সব উদ্যোগের বিষয়ে জানতে বলেন, ‘সরকারি অফিসগুলো তৈরি করা হয় জনসাধারণের কাজের জন্য। আমি যদি আমার অফিসে প্রবেশের জন্য কাউকে বাধা দিই, অফিসের ও সাধারণ মানুষের মাঝে পর্দা দিই, দেয়াল তুলি, তাহলে তারা কীভাবে সেবা নেবে। আমরা চাই জনসাধারণের সঙ্গে প্রশাসনের কোনো দূরত্ব থাকবে না। জনসেবার জন্যই আমাদের প্রশাসন। আমার এখানে সেবা নিতে এসে অনেকেই অনুমতি চান। আমার অফিসে আসার জন্য অনুমতির কেন প্রয়োজন পড়বে?’
তিনি আরো বলেন, ‘আগে আমার অফিসের সামনে অনেক লোক জড়ো হয়ে থাকতো। ভয়ে অনেকে ভেতরে প্রবেশ করতো না। এখন সবাই নির্ভয়ে তাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অফিসে কথা বলতে আসে। কেউ আসেন সামাজিক সমস্যা কিংবা অভিযোগ নিয়ে। দরিদ্র মানুষরা বয়স্কভাতা, বিধবাভাতার জন্য আসেন। কৃষক আসেন জমিতে সেচ যন্ত্র স্থাপনের ছাড়পত্রের বিষয়ে।’
হোসেনপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ভারপ্রাপ্ত মোঃ আব্দুল হাকিম বলেন, আমাদের উপজেলার ইতিহাসে এমন জনবান্ধব ইউএনও আমরা দেখিনি। উনি অল্প কয়েকদিনে যেভাবে সকলের ভালোবাসা ও দোয়া পেয়েছেন, এই দেশ একদিন উনার মতো ভালো লোকের কারণেই উন্নতির শিখরে আরোহন করবে। উনি আছেন আমাদের উপজেলার সকল মানুষের হৃদয়ে।
অনিন্দ্য মন্ডল খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলায় কায়েম খোলা হুলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢেউয়াতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ৩৪ তম বিসিএস এ নাটোরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিন বছর সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাঘের হাট জেলার মোল্লা হাটে । তিনি কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য জনপ্রশাসন পদক ২০১৮ অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালে শুদ্ধাচরণ পুরস্কার লাভ করেন। মানবসম্পদ উন্নয়ন ক্যাটাগরিতে পুনরায় জনপ্রশাসন পদক ২০২২ অর্জন করেন।
হোসেনপুর উপজেলায় নির্বাহী অফিসার হিসেবে ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ খ্রি তারিখে যোগদান করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সহিত দায়িত্ব পালন করে হোসেনপুর থেকে ২৪ নভেম্বর ২০২৪ বিদায় নেন। বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার ভেদারগঞ্জ উপজেলায় নির্বাহী অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। পারিবারিক জীবনে তিনি বিবাহিত। দুই কন্যা সন্তানের জনক।
অনিন্দ্য মন্ডল এর মতো সরকারি কর্মকর্তারাই একদিন বদলে দেবেন আমাদের দেশ। উনাদের মহতি উদ্যোগেই গড়ে উঠবে দুর্নীতিমুক্ত ও সোনার বাংলাদেশ।