মাত্র এক সপ্তাহ আগেও চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। সেটা এখন বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে ১২৫ শতাংশে।
গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের যেসব দেশের পণ্যে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন, গতকাল নয়ই এপ্রিল তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গতকালই তিনি জানিয়েছেন যে চীন, কানাডা ও মেক্সিকো বাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর ধার্যকৃত পাল্টা শুল্ক আগামী ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকবে। তবে এই ৯০ দিন, অর্থাৎ তিন মাস এই দেশগুলোর সবার জন্য বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক হার প্রযোজ্য হবে।
এদিকে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো চীনা পণ্যে শুল্ক বাড়ালো যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাজারে চীনের পণ্যে সর্বশেষ ধার্যকৃত শুল্ক ছিল ১০৪ শতাংশ। বুধবার তা কার্যকর হওয়ার দিনই আবার বাড়ানো হয় শুল্ক। তবে চীন তবে এখনো পাল্টা কোনো পদক্ষেপের ঘোষণা না দিলেও তারা যে পিছু হটছে না তার ইঙ্গিত দিয়েছে চীন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, তাদের সরকার ‘উসকানিকে ভয় পায় না’।
এরই মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ করেছে চীন। মূলত গত ২ এপ্রিল বিশ্বের অনেক দেশের মতো চীনের ওপরও ৩৪ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই শুল্ক আরোপের এক দিনের মাথায় গত ৪ এপ্রিল চীনও সমান হারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগেই বলেছিলেন যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহার না করলে দেশটির ওপর আরো ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হবে।
কিন্তু চীন যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি মেনে নিয়ে চীনে মার্কিন পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করেনি। তাই গত ৯ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর আরো ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন। সবমিলিয়ে চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক হয় ১০৪ শতাংশ।
এর আগে গত মার্চেও চীনা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পণ্যের ওপর ক্রমশ শুল্ক বৃদ্ধির এই হার চমকে দেয়ার মতো। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের উচ্চ হারের শুল্ক আরোপ করা হলে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি করে লাভ করা প্রায় অসম্ভব।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকস কনসালটেন্সির লুইস লু বলেন, ইতোমধ্যেই এই অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাবে পড়েছে।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য নীতিবিষয়ক অধ্যাপক এসওয়ার প্রসাদ বলেছেন, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে স্থানীয় ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করছে। কারণ অন্য দেশগুলো ইতিমধ্যে চীনা পণ্যের ঢল থামানোর জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে।
চীনের অর্থনীতিতে রফতানি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। তাই নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হবে অভ্যন্তরীণ ভোক্তা চাহিদা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া।
যেহেতু চীনের অর্থনীতি রফতানিনির্ভর। তাই এই অতিরিক্ত শুল্কের চাপ সামলানো দেশটির জন্য কঠিন হতে পারে। কারণ চীনের অর্থনীতি বর্তমানে মূল্যহ্রাস বা ডিফ্লেশনের মধ্যে রয়েছে।
এই শুল্কহার চলমান থাকলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের আরো অবমূল্যায়ন হতে পারে। তখন এই দুর্বল ইউয়ান অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনা পণ্যকে সস্তা করে তুলবে।
আজ বৃহস্পতিবার গত ১৯ মাসের মাঝে ডলারের বিপরীতে ইউয়ান সর্বনিম্নতে নেমে এসেছে।
এদিকে এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক কমাচ্ছে না চীন। বরং গতকাল যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে আরো অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর চীনও তার বাজারে মার্কিন পণ্যে ফের পাল্টা ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে, চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় দেশটির নাগরিকদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে এবং সব ধরনের ঝুঁকি বিবেচনা করতে বলেছে।
সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ‘চীন-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্কের অবনতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে’ এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এছাড়া চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা একটি সতর্কবার্তায় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি মূল্যায়ন’ করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ওহাইও-তে সম্প্রতি একটি বিল পাস হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনের প্রভাব কমাতে চায়। ওই প্রতিক্রিয়াতেই চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই সতর্কবার্তা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শেয়ার বাজারগুলোয় চীনের অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন যে তাদের সরকার ‘উসকানিকে ভয় পায় না’।
তিনি কোরিয়ান যুদ্ধের সময় সাবেক চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সেতুং-এর একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। যেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘এই যুদ্ধ যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, আমরা কখনই আত্মসমর্পণ করব না।’
ভিডিওর ওপরে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা চাইনিজ। আমরা পিছিয়ে যাব না।’
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের বিষয়টি দেখে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন যে তারা ইতিমধ্যে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের বেশিরভাগ অংশ নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম।
এছাড়া বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কিভাবে আলোচনা শুরু হতে পারে তার কোনো ইঙ্গিতও এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।
চীন এরইমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ করেছে, যেখানে ট্রাম্পকে ‘গুন্ডামি’ কৌশলে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বুধবার দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘(ওয়াশিংটনের) ৫০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি একটি ভুলের ওপরে আরেকটি ভুল, যা মার্কিন পদক্ষেপের একতরফা ধমকানোর প্রকৃতিকে তুলে ধরেছে।’
এর আগে গত ৪ এপ্রিল চীন ডব্লিউটিএ’র কাছে একটি আবেদন করেছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্কের বিষয়টি নিয়ে আলাপের কথা বলা হয়েছিল।
তাদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বেইজিং ‘ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুযায়ী তার বৈধ অধিকার এবং স্বার্থকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে বজায় রাখবে।’