বুধবার, ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২৫

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার মৃৎশিল্প ঐতিহ্যবাহী একটি বিশেষ শিল্পকলা যা আজও টিকে আছে

জাহিদ খান(কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি)

প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৫:১২ পিএম

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার মৃৎশিল্প ঐতিহ্যবাহী একটি বিশেষ শিল্পকলা যা আজও টিকে আছে

যান্ত্রিক সামগ্রীর আধিপত্য এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের যুগে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় মৃৎশিল্প এখনও জীবন্ত ঐতিহ্য হয়ে টিকে আছে। যদিও সময়ের পরিবর্তনে মৃৎশিল্পের কিছু ধারা বিলুপ্তির পথে, তবে কিছু দক্ষ এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্পী এখনও এই প্রাচীন শিল্পের কুড়ি ধরে রেখেছেন। তাদের মেধা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে এখনও তৈরি হচ্ছে মাটির হাঁড়ি, পাত্র, মূর্তি এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী মৃৎপাত্র, যা লোকশিল্পের অপরিবর্তিত রূপ।

 

নাগেশ্বরীতে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেক শিল্পী তাদের পরিবারের হাতের কাজে পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন এবং এই শিল্পের চর্চা আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছেন, যা একদিকে যেমন তাদের জীবিকার উৎস, তেমনি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত। যদিও বাজারে আধুনিক পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও এই শিল্পী সম্প্রদায় তাদের কাজের মাধ্যমে মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখছে।

 

 

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের কৈয়াপাড়া গ্রামে শত বছর ধরে মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজ হয়ে আসছে। এই গ্রামের মৃৎশিল্পীরা এখনও সুনিপুণভাবে তৈরি করছেন মাটির হাঁড়ি, কলস, সরা, কুয়ার পাট, ব্যাংকসহ নানা প্রয়োজনীয় পণ্য। এইসব জিনিসপত্র বিশেষ করে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, যার ফলে চাহিদা বাড়ে।

 

কৈয়াপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পীরা, যেমন বলাই পাল (৫২), মুকুল পাল (৪৮), শরৎ পাল (৬৪), সুবাস পাল (৫২), রঞ্জিত পাল (৫০), পরিমল পাল (৪৮) এবং সুবোল পাল (৫০) প্রমুখ, এখনও প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে ধরে রেখেছেন। তাদের দক্ষতা এবং প্রতিভা মাটির মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করে, যা আজও এলাকাবাসী ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। এভাবে, তারা মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, যা আধুনিকতার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাচীন এই শিল্প।

 

 

 

কৈয়াপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পী লাল চান পালের কথা মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। তিনি জানান, তার দাদা কানাই চন্দ্র পাল এই শিল্পের একজন অভিজ্ঞ কারিগর ছিলেন এবং তার বাবা সুশীল চন্দ্র পাল দাদাকে সহযোগিতা করতেন। ছোটবেলা থেকেই লাল চান পাল তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এই কাজ শিখেছেন এবং বহু কষ্ট ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাটিকে ধরে রেখেছেন।

 

তবে, লাল চান পাল তার পরবর্তী প্রজন্মের এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখার সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান। আধুনিকতার চাপ এবং যান্ত্রিক সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে আসছে, যা এই ঐতিহ্যবাহী পেশার টিকে থাকার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হলেও, তার নিজের কাজ এবং ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

 

এটি প্রমাণ করে, মৃৎশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, বরং এটি একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন, যা এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি শিল্পীদের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করবে।

 

 

পরিমল পালের বক্তব্য এবং নাগেশ্বরীর মৃৎশিল্পের বাস্তব চিত্র একটি গভীর ভাবনার বিষয়। তাদের দিন চালানো কঠিন হলেও তারা মাটির প্রতি যে মায়া এবং ভালোবাসা দেখাচ্ছেন, তা একদিকে যেমন তাদের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, তেমনি অন্যদিকে তাদের সংগ্রামের প্রমাণ। কিন্তু, প্লাস্টিক ও স্টিলের সহজলভ্যতা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রসারের কারণে তাদের পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

 

নাগেশ্বরীর সচেতন মহলের মতামত অনুযায়ী, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার পাশাপাশি আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং নতুন ডিজাইন সংযোজন অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক বাজারে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন উন্নত বিপণন ব্যবস্থা এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদের পণ্য প্রচার।

 

মৃৎশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প যা আমাদের সংস্কৃতি ও শিকড়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নাগেশ্বরীর মৃৎশিল্পীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করে আমরা এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি। এটি শুধুমাত্র ঐতিহ্য রক্ষারই কাজ নয়, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।

 

যান্ত্রিক যুগে নাগেশ্বরীর মৃৎশিল্পের সংগ্রাম ও টিকে থাকার এই কাহিনি আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে ঐতিহ্যের প্রতি দায়িত্বশীল হতে। এই শিল্প বাঁচাতে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন।