সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলেই নজরে পরে আকর্ষণীয় কিছু চিকন স্বাস্থ্য মোটা করুন, মেদ, ভূড়ি ও ওজন কমান এরকম আরো বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বেশি নজর পড়ে এলিট কর্পোরেশনের ন্যাচারাল ফুড বাদাম শেক, মিল্ক শেক, ন্যাচারাল হেলথ ও ন্যাচারাল ফুড সাপ্লিমেন্ট বিভিন্ন পণ্যের। এগুলোর বিজ্ঞাপন করা হয় সেলিব্রেটিদের দিয়ে।
কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠান থাকলেও সরজমিনে সেসব প্রতিষ্ঠানে কোন অস্তিত্ব নেই। এসব ব্লেককেস প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভোক্তাদের প্রতারণা, আয়কর ফাঁকি দেয়া, অর্থ পাচার, বিশেষ অভিযানে আইনের জটিলতা থেকে দূরে থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের সঠিক কোন তথ্য অথবা অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন গুলো দেখে বুঝার কোন উপায় নেই এলিট কর্পোরেশন নামে একটি ভূঁইফোর প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
কাগজ কলমে এই ব্লেককেস প্রতিষ্ঠান এলিট কর্পোরেশনের কর্ণধার আছিবউর রহমান। ছেলে মো. ইসমাইল। এই ব্লেককেস কোম্পানির মূল মাস্টারমাইন্ড রয়েছে গোপনে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
চট্টগ্রাম নগরীর ৯নং ওয়ার্ড, পশ্চিম কুয়াইশ চৌধুরী বাড়িতে এলিট কর্পোরেশনের হারবাল পন্য তৈরির একটি ফ্যাক্টরি ছিল এবং সেখানে বিভিন্ন হারবাল প্রোডাক্ট তৈরী করা হতো। গত ২০২৩ সালের জুন মাসে একটি অভিযানে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু একটি ফ্যাক্টরী বন্ধ হলেও বিভিন্ন জায়গায় এখনো গোপন ফ্যাক্টরী করে পণ্য তৈরি করছে এলিট কর্পোরেশন।
এই ব্লেককেস প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিষয়ে অনুসন্ধানে কিছু তথ্য উঠে আসে, এলিট কর্পোরেশনে পণ্যগুলো যাদের মাধ্যমে বিক্রি করাছে তারা হলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাবেদ সিদ্দিকী নীল, ডিরেক্টর আজিম, ডিরেক্টর আবু নায়েম, ডিরেক্টর ইফতেখার ইফতি, ডিরেক্টর রাসেল, ডিরেক্টর সুমন রাফিসহ ডিরেক্টর পর্যায়ে অর্ধ শতাধিক লোক কাজ করেন। তাদের অধীনে প্রায় ৫ হাজার কর্মী কাজ করছে।
এর ডিরেক্টরদের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, ডিরেক্টরগুলো প্রত্যেকে একই প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তা তৈরি প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা তৈরীর প্রশিক্ষণ যারাই নিয়েছে সবাইকে ব্লেককেস প্রতিষ্ঠান এলিট কর্পোরেশনের পণ্য বিক্রির সাথে সম্পৃক্ত পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গুদাম নিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ব্যবসা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব গুদাম গুলোতে খুবই গোপনে মালামাল মজুদ করা হয়। মালামাল বিক্রির উদ্দেশ্যে রিক্সা ও সিএনজি ব্যবহার করে কুরিয়ার অফিসে পাঠানো হয় আবার কয়েকটি গুদাম থেকে সরাসরি পাঠাও কুরিয়ার ও স্ট্রিট ফাস্ট কুরিয়ারের গাড়িতে করে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয় মরণব্যাধি পণ্যগুলো।
এক সময় আওয়ামী নেতাকর্মীকে হাত করে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করলেও গণঅভ্যুত্থানের পর উদ্যোক্তর তৈরি প্রতিষ্ঠানটি কর্ণধার কামরুল কায়েস চৌধুরী এখন বিএনপি ও জামায়াতের বিভিন্ন নেতাকর্মীর সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে কোন প্রকার বাঁধা ছাড়াই চালিয়ে যেতে পারে তার এ সকল অবৈধ কর্মকাণ্ড।
অনুসন্ধানের একপর্যায়ে প্রতিবেদকের হাতে এলিট কর্পোরেশনের একটি ট্রেড লাইসেন্স হাতে আসে, সেখানে দেখা যায় এলিট কর্পোরেশনের কর্ণধার আছিবউর রহমান ছেলে মো. ইসমাইল হলেও ট্রেড লাইসেন্সে থাকা মোবাইল নাম্বারটি উদ্যোক্তা তৈরি প্রতিষ্ঠান কর্ণধার কামরুল কায়েস চৌধুরীর পার্সোনাল বিকাশ নাম্বার।
তথ্য মতে, ২০২৩ সালে আগষ্ট মাসের ৩ তারিখ বিপুল পরিমাণ ভেজাল হারবাল ঔষধ ও নকল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রির দায়ে চট্টগ্রাম মহানগর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ ডিবি (উত্তর ও দক্ষিন) এসব বিষাক্ত পণ্য উদ্ধার সহ গ্রেফতার করে ৭ জনকে। সিএন্ডবি কলোনীর বিপরীত পাশের অফিস থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, মো. আইয়ুব হেলালী, আদর চৌধুরী ওরফে হিমু , মো. শরীফ হাসান , মো. সরোয়ার হোসেন , মো. ইমরানুল হক, আব্দুর রহমান এবং আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল ইমন সে মামলায় অজ্ঞাতনামায় উদ্যোক্তা তৈরি প্রতিষ্ঠান জিএমআইটি কর্ণধার কামরুল কায়েস চৌধুরীর নামও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন,
আমার অধীনে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা কাজ করতো। আমার ডিরেক্টর ছিলেন আইয়ুব হেলালী। যে ডিবির মামলায় প্রথম আসামি। দৈনিক পূর্বকোণের পাশে আমাদের যে অফিসটি ছিল। সেই অফিসে ডিবি অভিযান পরিচালনা করে অভিযানের সময় উদ্যোক্তা তৈরি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কে অনেকবার কল দিয়েছি তবে সে কল না ধরায় সেই প্রতিষ্ঠানে সেকেন্ড অফ কমান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাবেদ সিদ্দিকীর নীল কে কল দেয়া শুরু করি সেও কল রিসিভ করেনা তারপরে ডিরেক্টর নাজেদুল আলম জিসান কয়েকটি কল সেও কল রিসিভ করে না। সে অভিযানে আইয়ুব হেলালি সহ ৯ জনকে গ্রেফতার ও মালামাল জব্দ করে ডিবি। যদি তাদের পণ্যগুলো লিগ্যাল হতো তাহলে প্রশাসন কেন অভিযান দিবে।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন অক্সিজেন মোড়স্থ সেকান্দর বিল্ডিং এর ৪র্থ তলা হেয়ার টার্চ নামক রুমের ভিতর হইতে পুলিশের অভিযানে অবৈধ ভেজাল যৌন উত্তেজক ও হারবাল ঔষধ বাজারজাতের দায়ে ৩ জনকে আটক সহ মামলা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার কৃত মামলা গুলো হচ্ছে ৯১০টি প্লাস্টিকের কৌটা, খোলা ২ কেজি ৩৫০ গ্রাম কথিত সেক্সের ট্যাবলেট, ১৮০টি খালি কৌটা, লম্বা ছোট ১টি রোল, ১টি কাগজের কার্টুনের ভিতরে ২০ প্যাকেট Organic MACA powder, ১টি কৌটার মুখের লেভেল লাগানোর মেশিন, ১টি পুরাতন সি.পি.ইউ, ১টি মনিটর, ১টি মাউস, ১টি কি-বোর্ড, ২০০ পিচ লেভেল উদ্ধার করা হয়।
স্বাস্থ্যবীদ অধ্যাপক ডাঃ ইদ্রিস আলী কাছে ভুয়া হারবাল পণ্য ক্ষতিকর দিক ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সাংবাদিককে মামলার হুমকি দিয়ে মামলা করার বিষয় মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব ভুয়া হারবাল পণ্যের কেমিক্যাল নির্ধারিত পরিমাণে থাকেনা কারণ তাদের কাছে পরীক্ষা করার মত কোন যন্ত্র নেই। এই কেমিক্যাল নির্ধারিত পরিমান না থাকায় ও পরিমাণে গরম মিল থাকায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পড়তে পারে যেমন ক্যান্সার, হার্ট ব্লক, কলেস্ট্রল মাত্র বেড়ে যাওয়া ও কিডনির ড্যামেজ এর মত ক্ষতিকর প্রভাব করতে পারে। বি এস টি আই যে বিষয়টি আপনি জানিয়েছেন সেটা আসলে অল সংকট ও আইন থাকলেও আইন প্রয়োগের বিলম্বনা কারণে এইসব ভইপুর পণ্যগুলো অনলাইনে বিক্রি করা হয়। এসব পণ্য বেশিরভাগ সময় দোকানপাটে বা সুপারশপে তেমনটি নজরে পড়ে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিক নজরদারির অভাব ও কিছু কর্মকর্তা অনৈতিক উপায় অবলম্বন করায় এই ব্যবসা গুলোর দাপিয়ে চলছে । আরো একটি বিষয় প্রতিবেদন করার পর মাঝেমধ্যে অনুসন্ধান করাকালীন সাংবাদিকের উপর যে হামলা মামলার হুমকি প্রদান ও হামলা করা তাদের একটি দীর্ঘদিনের কালচার। এসব ভুয়া পণ্য উৎপাদন কারি ও বিক্রয়কারীরা মূলত একটি বিশাল চক্র এ চক্রের মধ্যে কিছু অসাধু প্রশাসন ও কথিত সাংবাদিকরা জড়িত থাকায় এ হামলা, মামলা ও সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে ভুল সংবাদ প্রকাশ তাদের নিত্যদিনের কাজ।
চট্টগ্রাম সিআইডির এসপি বলেন, আপনারা জানেন আমরা দীর্ঘদিন যাবত অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছি তারই ধারাবাহিকতায় এসব ক্ষতিকর হালবাল পণ্যের বিষয়ে ও পরিপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের পর আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) গণমাধ্যম বলেন, অতীতে আমরা যেভাবে অভিযান করেছি এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি পরবর্তীতে আমরা তথ্য প্রমাণ পেলে পর্যায়ক্রমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জিএমআইটি কর্ণধর কামরুল কায়েস চৌধুরীর সাথে এই বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে প্রতিবেদক যোগাযোগের বিলম্ব হয়।