বাংলাদেশে ব্যাটারি (লিড এসিড ও ড্রাই এসিড) উৎপাদন কারখানা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে স্থানীয় উপজেলা বা সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন, শ্রম অধিদপ্তর থেকে নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নির্দেশনা ও অনুমতি, ফায়ার লাইসেন্স, বাংলাদেশ কেমিক্যাল সেফটি রেগুলেটরি অথোরিটি থেকে অনুমতি, উৎপাদিত ব্যাটারি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স, ব্যাটারি পরিবহনের জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতির নেওয়ার বিধান রয়েছে।
তবে সকল বিধি-বিধানকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যাটারি তৈরির কারখানা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর যথাযথ অনুমোদন ব্যতিরেকে শুধুমাত্র আবেদন করেই চলছে ব্যাটারি উৎপাদনের বিশাল কর্মযজ্ঞ। পরিবেশ ও জনজীবনকে হুমকিতে ফেলে বছরের পর বছর এসব অবৈধ ব্যাটারি কারখানার মালিকরা কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুফে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, অবৈধ ব্যাটারি কোম্পানিগুলোর উৎপাদনের উপর যে পরিমাণ ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা সেটিও ফাঁকি দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্তাদের ম্যানেজ করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাভারের আশুলিয়ায় যত্রতত্র অনুমোদনহীন ব্যাটারি কারখানার দূষণের কারণে হাজারো মানুষ, স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু রোডে অবস্থিত ইলং ব্যাটারি ফ্যাক্টরি ও ৭১ রিসোর্টের আশপাশে বসবাসকারী অনেকেই হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগব্যাধীতে ভুগছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে জমিতে ফসল হচ্ছে না, গাছে ফল ধরে না এবং পুকুরেও মাছ বাঁচতে পারছে না। ব্যাটারি কারখানায় ইটিপি না থাকায় পরিবেশের ক্ষতিকারক উপাদান এসিড মিশ্রিত বর্জ্য পানি ও সিসাযুক্ত ছাই সরাসরি ছড়িয়ে পড়ছে। এই ক্ষতিকারক এসিড ও সিসার ব্যবহারের ফলে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে নারী-শিশুরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে খোঁ নিয়ে জানা যায়, ‘ইলং ব্যাটারি’ ফ্যাক্টরি ও ‘৭১ রিসোর্ট লিঃ’ নামক কোন প্রতিষ্ঠানকে ব্যাটারি উৎপাদনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
আশুলিয়ার দোশাইদ এ কে স্কুল এন্ড কলেজ রোডে (জুলফিকার মাদবর মসজিদ সংলগ্ন) অবস্থিত ব্যাটারি কোম্পানি ‘৭১ রিসোর্ট লিঃ’ এর পরিচালক কামাল দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, পূর্বের ফ্যাক্টরিতে থাকাবস্থায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। তার মতে, ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র কিংবা ফায়ার লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই পরবর্তীতে তারা পরিবেশগত ছাড়পত্র না নিয়েই ব্যাটারি উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু রোডে ম্যাক্সিম লেভেল ফ্যাক্টরির পাশে জনবহুল এলাকায় অবস্থিত ইলং ব্যাটারি ফ্যাক্টরির কর্ণধার মিস চম্পার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে দৈনিক আজকের বাংলাকে বলেন, ‘আপনারাতো সব জানেন, লিখেন নিজেদের মতো, দেখবো প্রশাসন কি করে। সব ম্যানেজ করেই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি।’
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুবকর সরকার দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য হুমকিতে রয়েছে এমন কোন অবৈধ ব্যাটারি কারখানাকে ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্তপূর্বক বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা যায়, গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সিসা বা লেড ধাতু অনেকটা নীরব ঘাতকের মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘সিসা’কে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গর্ভাবস্থায় কেউ এ ধরণের ভারী ধাতুর সংস্পর্শে এলে শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং তার দৃষ্টি, শ্রবণ ও মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা থেকে শুরু করে আচরণগত সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। অথচ লোকালয়ের মাঝেই গড়ে উঠেছে শত-শত অবৈধ ব্যাটারি তৈরির কারখানা। যেখানে একটি ব্যাটারি তৈরিতে সিসা ও এসিডই হচ্ছে মূল উপাদান। গড়ে ওঠা এসব ব্যাটারি কারখানার মাধ্যমে মানুষসহ প্রাণীর শরীরে ঢুকছে সিসার বিষ।
সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ শিশু। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ চতুর্থ। ইউনিসেফ ‘দ্য টক্সিক ট্রুথ: চিলড্রেনস এক্সপোজার পলিউশন আন্ডারমিন্স এ জেনারেশন অব পোটেনশিয়াল’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন জানায়, বিশ্বজুড়ে প্রতি তিন শিশুর একজন বা প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম বা তারও বেশি। এ শিশুদের প্রায় অর্ধেকের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে আনুমানিক ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন যা বলছে: যেকোনো বর্জ্য, যা নিজস্ব ভৌত বা রাসায়নিক গুণগত কারণে বা অন্য কোনো বর্জ্য বা পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে বিষক্রিয়া, জীবাণু সংক্রমণ, দহন, বিস্ফোরণক্রিয়া, তেজস্ক্রিয়া, ক্ষয়ক্রিয়া বা অন্য কোনো ক্ষতিকর ক্রিয়া দ্বারা পরিবেশের ক্ষতিসাধনে সক্ষম। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, আমদানি, মজুদকরণ, বোঝাইকরণ, পরিবহনের ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, পরিবেশের ক্ষতিরোধকল্পে সরকার অন্যান্য আইনের বিধানসাপেক্ষে বিধি দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ধারণ, মজুদকরণ, বোঝাইকরণ, সরবরাহ, পরিবহন, আমদানি, রফতানি, পরিত্যাগকরণ ও ডাম্পিং ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।