দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের ব্যবহার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটারির চাহিদাও বেড়েছে। আর এই চাহিদা মেটাতে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০০ কারখানা। যার বেশিরভাগই সম্পূর্ণ অবৈধ। এর মধ্যে প্রায় ডজন খানেক অবৈধ ব্যাটারি কারখানা রয়েছে সাভারের আশুলিয়ার জনবহুল এলাকায়। স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা ও উদাসীনতায় নির্বিঘেœ চলছে এসব অবৈধ ব্যাটারি তৈরির কারখানা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই কারখানা মালিকরা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন কোন বাধা ছাড়াই। গত ৯ নভেম্বর দৈনিক আজকের বাংলার প্রথম পাতায় ‘অবৈধ ব্যাটারি কারখানায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ’ ও ২৫ নভেম্বর প্রথম পাতায় ‘এসিড-সীসায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ ও মানবজীবন’ শীর্ষক শিরোনামে ২টি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অবৈধ ব্যাটারি কারখানা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এতে করে এসব অবৈধ ব্যাটারি কারখানা নির্বিঘেœ চলার পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ আরও জোরালো হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ব্যক্তিস্বার্থের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই সাভারের আশুলিয়ায় স্কুল-কলেজ, বাসস্ট্যান্ড ও বাজার লগোয়া জনাকীর্ণ স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ব্যাটারি কারখানা।
আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু রোডে ম্যাক্সিম লেভেল ফ্যাক্টরির পাশে জনবহুল এলাকায় ২ বছর ধরে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ইলং ব্যাটারি কারখানা পরিচালনা করে আসছেন মিস চম্পা নামের এক নারী। এর আগে ইলং ব্যাটারির নাম ছিল টপ বুল। কোম্পানির নাম পরিবর্তন হলেও মালিক ছিলেন মিস চম্পাই। এসব কারখানার বেশির ভাগ মালিকই হচ্ছেন চীনের নাগরিক। তারা মিস চম্পার মতো স্থানীয় ব্যক্তিদের জমি বা স্থাপনা ভাড়া নিয়ে এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন। দেশের প্রায় ৮০ ভাগ কারখানাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে চীনের বিনিয়োগে চলছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কারখানা থেকে যখন-তখন সীসাযুক্ত কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। এতে ঐ এলাকার বাসিন্দাদের শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। ইলং ব্যাটারি কারখানার কর্ণধার মিস চম্পা দৈনিক আজকের বাংলাকে বলেন, ‘আপনারাতো সব জানেন, লিখেন নিজেদের মতো, দেখবো প্রশাসন কি করে। সব ম্যানেজ করেই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি।’
আশুলিয়ার দোশাইদ এ কে স্কুল এন্ড কলেজ রোডে (জুলফিকার মাদবর মসজিদ সংলগ্ন) অবস্থিত ব্যাটারি কোম্পানি ‘৭১ রিসোর্ট লিঃ’। এই কোম্পানির উৎপাদন কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈধভাবে প্রায় ৪ বছর ধরে চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে ব্যাটারি কারখানার দূষণের কারণে হাজারো মানুষ, স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। কারখানার আশপাশে বসবাসকারী অনেকেই হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগব্যাধীতে ভুগছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে জমিতে ফসল হচ্ছে না, গাছে ফল ধরে না এবং পুকুরেও মাছ বাঁচতে পারছে না। ব্যাটারি কারখানায় ইটিপি ও এটিপি না থাকায় পরিবেশের ক্ষতিকারক উপাদান এসিড মিশ্রিত বর্জ্য পানি ও সীসাযুক্ত ছাই সরাসরি ছড়িয়ে পড়ছে। এই ক্ষতিকারক এসিড ও সীসার ব্যবহারের ফলে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে নারী-শিশুরা।
এ ব্যাপারে ‘৭১ রিসোর্ট লিঃ’ এর পরিচালক কামাল দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, পূর্বের ফ্যাক্টরিতে থাকাবস্থায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। তার মতে, ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র কিংবা ফায়ার লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই পরবর্তীতে তারা পরিবেশগত ছাড়পত্র না নিয়েই ব্যাটারি উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুবকর সরকার দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য হুমকিতে রয়েছে এমন কোন অবৈধ ব্যাটারি কারখানাকে ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্তপূর্বক বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অবৈধ হওয়ায় খুব সহজেই সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন ব্যাটারি কারখানার মালিকরা। ব্যাটারি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করলেও সরকারি কোষাগারে প্রকৃত ভ্যাট জমা হয় না।
এ বিষয়ে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিন দৈনিক আজকের বাংলাকে জানান, আমরাও অসহায়। পরিদর্শনের খবর আগে থেকে পেয়ে কারখানার বাইরে তালা ঝুলিয়ে সবাই পালিয়ে যায়। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখব। উল্লেখ্য, ব্যাটারির অন্যতম উপাদান সীসা। নামে ব্যাটারি তৈরির কারখানা হলেও এগুলোতে নিয়মিতই পোড়ানো হয় সীসা। আর সীসা পুড়িয়ে বানানো হয় ব্যাটারির প্লেট।
একটি গবেষণায় জানা গেছে, সব রকম বাধা অতিক্রম করে সীসার একটি অংশ মস্তিষ্কের আশপাশে জমা হয়ে ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’ বাড়ায়। মস্তিষ্কের কোষে ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ পদ্ধতিকে দুর্বল করে। এটিই মূলত আচরণগত পরিবর্তনের বড় কারণ। গবেষক দলটি আরও জেনেছে, বংশপরম্পরায় সীসার এই ক্ষতিকর প্রভাব কয়েক গুণ বাড়ে। অর্থাৎ ইঁদুরের স্মৃতিশক্তি, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত করে সীসা। যেটি একই রকমভাবে মানুষের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। সীসার বিষক্রিয়ায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে শিশুরা। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি দুই শিশুর একজন আক্রান্ত হয় এই বিষক্রিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রক্তে সীসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই-যে কোনো পরিমাণে সীসা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ, কারণ তাদের শরীর দ্রুত সীসা শোষণ করে, যা মানসিক ও শারীরিক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।