রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অপরাধ দমন, জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কার্যক্রম চালু করা হয়। এটি বাংলাদেশের জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর। যেকোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে জরুরি সেবা পেতে দেশের যেকোনো স্থান থেকে যে কেউ এই নম্বরে ফোন করতে পারেন। যেকোনো ফোন থেকে বিনামূল্যে এ নম্বরে কল করা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত এ জরুরি সেবার সঙ্গে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সংযুক্ত রয়েছে। ৯৯৯–এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন দিনে গড়ে প্রায় ২৭ হাজার কল আসছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশনির্ভর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কার্যক্রমে ধস নেমেছিল। পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া ও তাদের ওপর হামলা হওয়ায় তখন পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য কর্মস্থলের বাইরে ছিলেন। এতে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের বেশির ভাগেরই কল গ্রহণ (রিসিভ) করা যায়নি। অবশ্য, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থানায় পুলিশ ফিরে আসায় ৯৯৯–এর স্বাভাবিক পরিষেবা শুরু হয়েছে। আস্থাও ফিরেছে মানুষের। তারপরও জনসাধারণের মনে প্রশ্ন? সত্যি কি আস্থার প্রতিদান দিতে পাচ্ছে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯?
সাধারণ মানুষের এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে গিয়ে, সরজমিনে চট্টগ্রাম নগরীর কয়েকজন ভোক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিপদকালীন সময়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নাম্বারটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। পুলিশিং সেবা থেকে শুরু করে সকল ধরনের সেবা পাওয়া যায় ৯৯৯ থেকে।।
৯৯৯ এ গত ১৩ নভেম্বর নগরীর কোতোয়ালি এলাকায় বাসায় বিপদগ্রস্ত তরুণীর সাহায্যে ফোনকলে এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। পরে ওই তরুণীকে তার পরিবারের জিম্মায় দেয়া হয়। ৩ অক্টোবর ইপিজেড থানাধীন দুই নম্বর ওয়ার্ডের শাকুয়াইল খালপাড় মহিলা বাজার থেকে হারুন নামে একজন ৯৯৯ এ ফোন করেন। তিনি জানান, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তার মামাতো ভাই আবুল কালামকে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন কয়েকজন। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ৯৯৯ ইপিজেড থানায় ফোন করে বিষয়টি জানায়। পরে থানা পুলিশ গিয়ে ভুক্তভোগীকে উদ্ধারসহ মারধর ও অগ্নিসংযোগ করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে।
এভাবেই প্রতিনিয়ত জনসাধারণকে নানাবিধ সেবা দিয়ে যাচ্ছে ৯৯৯। অবশ্য বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় কল করে হয়রানী করেন ৯৯৯ এ কর্মরতদের। আবার অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়েও বিভ্রান্তি করেছেন। বিরক্তিকর কল এড়াতে ৯৯৯ এ যুক্ত হচ্ছে ‘অটোকলার’। অপ্রয়োজনে ও মজা করার জন্য যেসব কল আসে, সেগুলোকে এই ধরনের কল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অটোকলার যুক্ত হলে গ্রাহক ৯৯৯-এ ফোন করলেই তার লোকেশন ও পরিচিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসবে কর্তৃপক্ষের কাছে। ৯৯৯ শুধু গ্রাহকের সমস্যা শুনবে এবং দ্রুত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করবে। ৯৯৯-এ অটোকলার যুক্ত হওয়ায় বিরক্তিকর কল কমে যাবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
৯৯৯ সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশ থেকে সাহায্য চেয়ে ২১ লাখ ৫৯ হাজার ২৮১টি কল এসেছে। এর মধ্যে পাঁচ ধরনের ঘটনায় বেশি কল আসে। সেগুলো হলো মারামারি, আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চুরি ও দুর্ঘটনা।
ওই সময়ে এ পাঁচ ধরনের ঘটনায় মোট ৪১ হাজার ৮৩০ জনকে জরুরি সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে মারামারি বা সংঘর্ষের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫১৭ জনকে সেবা দেওয়া হয়। ৯ হাজার ২৯৮ জনকে দেওয়া হয় চিকিৎসাসেবা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ৫ হাজার ৮৯৪ জনকে, দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ১৪৭ জনকে এবং চুরির ঘটনায় ৪ হাজার ৯৭৪ জনকে সেবা দেওয়া হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ৯৯৯ নম্বরে ৬৬ লাখ ৩৫ হাজার ৩১২টি কল এসেছে। এর মধ্যে ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪৯৭টি কলে সেবা দেওয়া হয়। সেবার হার ৫০ দশমিক ৫৬। বাকি ৩২ লাখ ৮০ হাজার ৮১৫টি কল জরুরি সেবার বাইরে হওয়ায় সেই সব কলারকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ওই সময়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১৪২টি জরুরি সেবা দিয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ সেবা দেয় ৩ লাখ ৫ হাজার ৫৩৭টি। সেবার হার ৮৫ দশমিক ৩১। ফায়ার সার্ভিস সেবা দেয় ২৩ হাজার ৯৫৭ এবং অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয় ২৮ হাজার ৬৪৮। সেবার হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬৯ ও ৮ শতাংশ।
উল্লেখ্য , ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘৯৯৯’ চালু হয়। এর পর থেকে গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় সাত বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৯৯৯-এ ফোন এসেছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ৮৮ হাজার ১০৭টি। এর মধ্যে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৮৮টি সেবা দেওয়া হয়েছে। সেবার হার ৪৩ দশমিক ৩৪। বাকি ৩ কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭১৯টি ফোনের কলদাতাকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ হার শতকরা ৫৬ দশমিক ৬৬।
সাত বছরে ৯৯৯-এ জরুরি সেবা চেয়ে কল আসে ১৯ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৪টি। এর মধ্যে পুলিশ সেবা দেয় ১৬ লাখ ৬ হাজার ২৪০টি, ফায়ার সার্ভিস ১ লাখ ৫৬ হাজার ১২৯ এবং অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয় ১ লাখ ৭০ হাজার ৯২৫টি।
জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার এডিসি কাজী তারেক আজিজ (গণমাধ্যম) বলেন, পুলিশের জাতীয় জরুরি পরিসেবার মান আগে থেকে অনেকাংশে জনবান্ধব হয়েছে। আগে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেবা নিতে ফোন দিলে আমরা প্রথমেই কলারের ঠিকানা সম্পর্কে জানতে চাইতাম। এতে সময় অপচয় হতো। এখন প্রতিটি কলের দ্রুত রেসপন্স করার জন্য কল করার সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যক্তির আইডেন্টিফিকেশন, লোকেশন এবং অবস্থান চলে আসে। তবে লোকবলসংকট থাকায় অনেক সময় সেবা দিতে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগষ্টের পর এই সেবার মান একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। অনেক পুলিশ কর্মস্থল থেকে আত্মগোপনে চলে যাওয়াতে জরুরি সেবার কার্যক্রম কিছুদিন বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে পুলিশ সংস্কারের মাধ্যমে পুনরায় চালু হওয়াতে জনগণ আবারও সঠিক পুলিশিং সেবা পাচ্ছে। জরুরি সার্ভিসের জন্য আরও সহজ হতো, যদি থানার টহল গাড়ির সংখ্যা, থানার জনবল বাড়ানো যেত। অর্থাৎ লজিস্টিক সাপোর্টের দরকার। যে লজিস্টিক সাপোর্ট রয়েছে, এসব দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।