বুধবার, ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২৫

জামালপুর পৌরসভার মেয়রের সিন্ডিকেট সদস্যরাই করতো সব কাজ : বঞ্চিত ছিলো ৩৯৫ ঠিকাদার

মোঃ মেরাজ উদ্দিন

প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর, ২০২৪, ০৫:১১ পিএম

জামালপুর পৌরসভার মেয়রের সিন্ডিকেট সদস্যরাই করতো সব কাজ : বঞ্চিত ছিলো ৩৯৫ ঠিকাদার

 



জামালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়রের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের ঠিকাদাররাই করতো যত উন্নয়ন কর্মকান্ড। এতে পৌরসভা লাখ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয়েছেন মেয়রসহ তার লোকজন। এতে বঞ্চিত ছিলো আওয়ামী লীগের বিরোধী ও দলনিরপেক্ষ ৩৯৫ জন ঠিকাদার। 
এসবকিছুই হয়েছে জামালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানুর আমলে। পৌরসভার উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের জন্য মেয়র ছানু গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব একটি বাহিনী। বঞ্চিত ঠিকারদারদের লাইসেন্স নবায়ন না করে পৌর মেয়রের নিজস্ব সিন্ডিকেটকে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ বঞ্চিত ঠিকাদারদের। 
এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি বঞ্চিত ঠিকাদারসহ সচেতন মহলের। আর বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন পৌরসভার বর্তমান  প্রশাসক। পৌর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, জামালপুর পৌরসভায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ঠিকাদারী লাইসেন্স ছিল ৩৭৬টি। ২০২১ সালে নির্বাচনের পর মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু দায়িত্ব নিয়ে আরও ৩৪ টি নতুন লাইসেন্স প্রদান করেন। এতে লাইসেন্স গিয়ে দাঁড়ায় ৪১০টিতে। পরে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে শুধুমাত্র ২১ টি লাইসেন্স নবায়ন করেন তিনি। বাকী ৩৮৯ টি লাইসেন্স নবায়ন করেননি। প্রতিটি লাইসেন্স নবায়ন করতে ২ হাজার ৩ শ টাকা সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দিতে হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী লাইসেন্স  নবায়ন খাতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭ শ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আরও ৬ টি লাইসেন্স কমিয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেয়রের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত মাহমুদুল হাসান অমিতের নামে মেসার্স এ এম এন্টারপ্রাইজ, মোফাখখারুল ইসলাম লিখনের এস এল এন্টারপ্রাইজ, মেয়রের ঠিকাদারী ব্যবসায়ার পার্টনার আশরাফুল ইসলাম সিদ্দিকী মামীমের মামীম এন্টারপ্রাইজ, ফুরকানুল আলম রিপনের রিপন এন্টারপ্রাইজ, আব্দুল আজিজের জেনি এন্টারপ্রাইজ ও মঞ্জুয়ারা বেগমের সাউথ এন্টারপ্রাইজসহ তার বিশ্বস্ত এবং ব্যবসায়ীক পার্টনারদের নামে ১৫ টি লাইসেন্স নবায়ন করেন মেয়র। আর এতে ওই অর্থ বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করেছে ৯ লাখ ৬ হাজার ২শ টাকা। পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তার নিজস্ব সিন্ডিকেটকে কাজ বাগিয়ে দিতেই শুধুমাত্র লাইসেন্স নবায়ন খাতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করেছেন ১৮ লাখ ৯ শ টাকা।  
এদিকে মেসার্স আর জে এন্টারপ্রাইজ, জেবি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স তিতাস কন্সট্রাকশন, মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ফিরোজ ট্রেডলিঙ্ক ও মেসার্স তামান্না এন্টারপ্রাইজসহ ৩৯৫ টি লাইসেন্স নবায়ন না করে পৌরসভার কাজ থেকে বঞ্চিত করেছেন ঠিকাদারদের।
বঞ্চিত ঠিকাদাররা অভিযোগ করে জানান, মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু ঠিকাদারী কাজ করার জন্য নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলে ছিলেন। সেই বাহিনীর ভয়ে কেউ লাইসেন্স নিয়ে কথা বলার সাহস করেননি। পৌরসভার সকল কাজ তার ওই বাহিনী নিয়ন্ত্রয়ন করতেন। তাদের দাপটে দলীয় নেতাকর্মীরাও কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 
মেসার্স জেবি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার মো.আনিছুর রহমান মুকুল বলেন, পৌরসভার মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানু দায়িত্ব নেওয়ার পরে কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করেননি। লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য পৌরসভায় গিয়ে তার সাথে কথা বলেছি। তিনি লাইসেন্স নবায়ন হবে না বলে জানিয়ে দেন। তখন তার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ সাহস পায়নি।’ তিনি তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার জন্য বর্তমান প্রশাসকের প্রতি অনুরোধ করেন।
মেসার্স জেবি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো.মনিরুল ইসলাম বিপ্লব বলেন, ‘মেয়র আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করেননি। তিনি শুধু নিজস্ব কয়েকটি লাইসেন্স নবায়ন করেছেন। আমরা কয়েকজন ঠিকাদার পৌরসভায় গিয়ে কথা বলেছি। আমরা একটা দরখাস্ত দিবো।’ বিগত সময়ের কাজগুলোও যাছাই করার জন্য অনুরোধ করছি। 
মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো.জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার লাইসেন্সর বয়স নয় বছর। আমি লাইসেন্স করার পর অনেক টাকার সিডিউল কিনেছি। কিন্তু পৌরসভার একটা কাজও পায়নি। তিনি ক্ষমতায় আসার পর আমার লাইসেন্স নবায়ন করেননি। আমরা সাধারন মানুষ, ব্যবসা করে খাই। কোন কিছু বলতে পারি নাই।
এ বিষয়ে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘ব্যক্তি স্বার্থের কাছে এদের রাষ্ট্র এবং সরকারি স্বার্থ ছিল নগন্য। তাই রাজস্ব আসল কি আসল না, এটা দেখার কিছু ছিল না। কোটি কোটি টাকা নানাভাবেই হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরই ধারবাহিকতায় ঠিকাদারী লাইসেন্স নবায়ন না করা এবং নিজেদের কিছু লোকদের মাধ্যমে কাজ করার জন্য গুটি কয়েক লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রশাসনিক ব্যবস্থাগ্রহনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।’   
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও পৌরসভার প্রশাসক শীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এ বিষয়টি জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে তিনি জানান।’
মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু গত ২০২১ সালের ২৪ মার্চে দায়িত্বগ্রহন করেন। পরে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে যান তিনি। গত ১৮ আগস্ট তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পান। পরে সরকারি নির্বাহী আদেশে পৌরসভার দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। এবিষয়ে তার বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইলে বা বাসায় যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।ম