মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ তুলে দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওলট–পালট হয় শিক্ষাক্রমও। পুরোনো শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে বিভাগ বিভাজন ফিরে আসছে ১ জানুয়ারি থেকে।
শুধু শিক্ষাক্রম নয়, এ বছরে শিক্ষায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা নানা কারণে পরিবর্তন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে এইচএসসির কয়েকটি পরীক্ষা বাতিল ও বিশেষ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন, পাঠ্যবই–সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি গঠনের পর তা বাতিল, সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়ে’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে পরে তা আন্দোলনের মুখে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে বছরজুড়ে শিক্ষায় নানা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বদল সিদ্ধান্তহীনতা আর অস্থিরতা ছিল।
এদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। আর মাত্র একদিন বাকি। নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হওয়ার অপেক্ষায় চট্টগ্রামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। তবে শেষ সময়ে এসেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এখনও বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই ছাপাতে ব্যর্থ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উদ্ভুত দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পাঠ্যবইয়ে সংযোজন ও বিয়োজন এবং পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যাদেশ দিতে দেরি হওয়ায় বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যের পাঠ্যবই উঠবে না কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে।
এছাড়াও ২০২৫ সালের জানুয়ারি যত এগিয়ে আসে, সংকট তত বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল এনসিটিবি। সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। নতুন বছরের প্রথম দিন স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরির সব শিক্ষার্থীর হাতে দুটি বইও উঠবে না। সবার হাতে বই তুলে দিতে না পারলেও ডিসেম্বরের বাকি দুদিনে সব স্কুলে অন্তত কিছু বই পাঠানোর লক্ষ্য এনসিটিবির।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কার্যক্রম প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে শুরু হয়। এবার মার্চ-এপ্রিলের দিকে কিছু কাজ হলেও আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে অনেককিছু এলোমেলো হয়ে যায়। কারিকুলাম পরিবর্তন, পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন, মুদ্রণ কার্যাদেশ প্রদানে বিলম্বের কারণে ছাপানোর কাজ দেরিতে শুরু হয়।
চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে, এবার চট্টগ্রামে নতুন বইয়ের চাহিদা রয়েছে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৩টি। ইবতেদায়ি, দাখিল, দাখিল ভোকেশনাল, মাধ্যমিক ভোকেশনাল, মাধ্যমিক বাংলা ও ইংলিশ ভার্সন মিলে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯৪ জন। এর মধ্যে কোনো বইই এখনো পৌঁছেনি। মাধ্যমিকের কোনো বই না পৌঁছার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা। এদিকে মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো বই না এলেও গত বুধবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রাথমিকের ২৪ শতাংশের মতো বই এসেছে, যা এরই মধ্যে বিতরণও শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের ৬ থানা শিক্ষা অফিস ও সব উপজেলা মিলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৫৩৪ জন। এদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ জন। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ হাজার ৭৯০ জন।
এ ছাড়া চট্টগ্রামের স্কুলগুলোতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় লেখা বইয়ের চাহিদা রয়েছে ৬৭১টি, যা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং নগরীর পাঁচলাইশ থানা শিক্ষা অফিসের আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং গারো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের মাতৃভাষায় লেখা বই পেয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুর রহমান বলেন, আমাদের বই আসছে। আমরা আশা করছি বছরের প্রথম দিন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে একটা করে হলেও বই তুলে দেব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা বলেন, আমাদের গতকাল থেকে বই আসা শুরু করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত বলার মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বই আসেনি। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির সাতটি বিষয় আর সপ্তম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের বই এসেছে। তবে তাও সংখ্যায় বলার মতো না। এজন্য বলছি না। তবে বই আসা শুরু করেছে। কিছু লোডিং হচ্ছে আর কিছু এখনো আনলোডিং আছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে এ শিক্ষা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সব বই পেতে পেতে আমাদের পুরো জানুয়ারি মাসটা লাগতে পারে। তবে আমার কাছে এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য নেই। ধারণা করছি, প্রযুক্তির কল্যাণে জানুয়ারির মধ্যে সব বই আমরা পেয়ে যাবো।।
এদিকে বছরজুড়ে শিক্ষাঙ্গন ছিল আন্দোলনে অস্থিরতা।
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি নিয়ে প্রজ্ঞাপন বাতিল করাসহ তিন দফা দাবিতে এ বছরের ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একযোগে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেন। এ কারণে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনিক ভবনেও কোনো কাজ হয়নি।
শিক্ষকদের এই দাবির বিষয়টি সরকার প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ৩ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রত্যয় স্কিমসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদায়ী বছরটি কেমন গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো বিদায়ী বছরটা শিক্ষা খাতে একটু অবহেলা করা হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কমিশনও হলো না। আগামী বছরটি শিক্ষার জন্য অনুকূল থাকবে কি না, তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনিশ্চয়তা দেখছেন তিনি। তবে তাঁর আশা, আগামী বছর শিক্ষা কমিশন হবে এবং তার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য বছরটি ভালো যাবে।