কামরুল হাসান, চট্টগ্রাম
বিজয়ের মাস শুরু হলে সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও বিজয় মেলা শুরু হয়। সম্প্রতি মেলার নামে খেলার মাঠ দখলের তোড়জোড় শুরু হয়েছে নগরজুড়ে। মেলার মৌসুম হিসেবে পরিচিত শীতকালে এ তৎপরতা বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। কোথাও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে আবার কোথাও অবৈধভাবেই চলে এসব মেলার আয়োজন। এতে বাদ যায় না স্কুল মাঠ থেকে শুরু করে জেলা স্টেডিয়ামও। মাসব্যাপী এসব মেলায় মাঠ ক্ষতবিক্ষত করে বানানো হয় ইট-সিমেন্টের স্থাপনা। ফলে মেলা শেষে অনুপযোগী হয়ে পড়ে এই সকল খেলার মাঠ। এ নিয়ে খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির ঐতিহ্যবাহী আউটার স্টেডিয়ামের খেলার মাঠ দখল করে ৭ দিনব্যাপী বিজয় মেলা বসানোর কার্যক্রম চলছিলো কয়েকদিন ধরে। স্থানীয় শিশু-কিশোর ও খেলোয়াড়দের খেলাধুলার অন্যতম মাঠটি এখন মেলার দখলে থাকায় বন্ধ রয়েছে সবধরনের খেলাধুলা। ফলে স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া মেলা আয়োজনের এমন অনুমোদনে ক্ষোভ বিরাজ করছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সর্ব মহলে।
বিজয়ী মেলার ইতিহাস নির্ভর কোন কিছুই থাকে না এসব মেলায়। মেলার মাঠ ক্ষতবিক্ষত করে বসানো হয় অসংখ্য বাণ্যিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্টলসহ দেশী-বিদেশী পণ্যে দোকান। এ নিয়ে খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভ থাকলেও সরাসরি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে হওয়ায় কোন প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি কেউ।
আবার অনেকে দুঃখ প্রকাশ করে এমন সবুজে ঘেরা সুন্দর মাঠে মেলার আয়োজন থেকে কতৃপক্ষকে সরে আসার জন্যে বিভিন্ন দাবি জানান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চট্টগ্রামের লোকাল খেলোয়াড়দের মাঝেও মেলার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
তবে ইতিমধ্যে নগরজুড়ে নানা বিতর্কের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম জানান, আউটার স্টেডিয়াম থেকে মেলা সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের ক্রীড়ামোদী খেলোয়াড় এবং শিশু-কিশোদের অনুশীলনের বিষয়টি বিবেচনা করে নগরীর কাজির দেউরী মাঠে (আউটার স্টেডিয়াম) অনুষ্ঠিতব্য বিজয় মেলার ভেন্যু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 'চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে’ শিরোণামের এই মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক সিআরবিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি।
আউটার স্টেডিয়াম থেকে মেলা সরানোর সিদ্ধান্তে জেলা প্রশাসনের এমন সুন্দর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান চট্টগ্রামের বিভিন্ন পেশাজীবি, ক্রীড়া সংস্থা ও চট্টগ্রামের খেলোয়াড়রা। খেলার মাঠ স্টেডিয়াম থেকে মেলা অন্যত্র সরানোয় জেলা প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন অনেকে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে কাজির দেউরি আউটার স্টেডিয়ামে ৮-১২ টি একাডেমি জেলা ও উপজেলার খেলোয়াড়রা প্রশিক্ষণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বেসিক ক্রিকেট একাডেমি,ব্রাইট ক্রিকেট একাডেমি, চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ক্রিকেট একাডেমি,সি স্পোর্টস একাডেমি সহ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি একাডেমি। এতে দৈনিক জেলা ও উপজেলার ২০০-২৫০ খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। কিন্তুু মাঠে মেলা করায় খেলার পরিবেশ ও প্র্যাকটিস করতে পারছে না তারা কেউ। অন্যদিকে অনেক একাডেমি মেলার কারণে প্র্যাকটিস বন্ধ ঘোষণা করেছে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক অর্জন-সাফল্যের সাক্ষী এই মাঠ। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের মতো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের এই খেলার মাঠ থেকে।
দীর্ঘদিন দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হওয়া আউটার স্টেডিয়াম ফিরে পায় নতুন ‘প্রাণ’। ৬০ লক্ষ টাকা খরচে সাজানো হয়েছিল আউটার স্টেডিয়াম। সবুজ ঘাসে নান্দনিকভাবে পুরোনো রূপ ফিরে পায় ঐতিহাসিক এই খেলার মাঠ। তিন দশক ধরে পতিত জমিতে পরিণত হওয়া আউটার স্টেডিয়াম যেন ‘সবুজ গালিচা’ ভরা। পুরো মাঠ সবুজ ঘাসে ভরে যাওয়ায় এটি আশপাশের এলাকার চেহারাও বদলে দিয়েছে। তবে এমন পরিবর্তন ছিল চ্যালেঞ্জের ছিল অনেক কঠিনও। তারপরও হারিয়ে যাওয়া সবুজ ঘাসের নান্দনিক আউটার স্টেডিয়ামটি চট্টগ্রামবাসীকে আবারও ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তৎকালীন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।
২০২৩ সালে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের ঘোষণা খেলার মাঠে আর হবে না মেলা। ভবিষ্যতে খেলার মাঠে কোন ধরণের মেলাসহ সকল প্রকার মেলা আয়োজন বন্ধের ঘোষণা করেন সাবেক জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
চট্টগ্রাম শহরের শিশু-কিশোর ও তরুণদের খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রাণকেন্দ্র আউটার স্টেডিয়াম। আগামী ৯ ডিসেম্বর সোমবার থেকে সেখানে শুরু হতে চলছে ৭ দিন ব্যাপী বিজয় মেলা। এ মেলার আয়োজনের খবরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয় শহরজুড়ে।
খেলোয়াড়দের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাদকমুক্ত দেশ গঠনের জন্য সারাদেশে কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের খেলার প্রতি আহ্বান জানানোর কথা, কিন্তু দখলদারা কিভাবে খেলার মাঠ নষ্ট করে মেলার আয়োজন করে তা বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছে চট্টগ্রামের খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংস্থার জানতে চাওয়া। কিন্তু তার আগে আমাদের চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক নগরবাসী এবং খেলোয়াড়দের কথা চিন্তা করে সিআরবিতে মেলা বসানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায়।
এ-দিকে আউটার স্টেডিয়াম থেকে মেলা সরানোর সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এমনিতেই খেলার মাঠ নেই। তারপরও যদি এ মাঠ মেলার জন্য ব্যবহার করা হয় বিষয়টি আত্মঘাতী হবে। কাজির দেউরি মাঠ থেকে বিজয় মেলা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানান তিনি।