বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ৬, ২০২৫
তুষারের দেশ থেকে যাত্রা, বাংলায় অবতরণ

শীতের ডানায় ভর করে অতিথির আগমন

প্রীতম সরকার (চট্টগ্রাম)

প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ১১:০১ পিএম

শীতের ডানায় ভর করে অতিথির আগমন

আকাশের অতিথি পাখি, বলো কোন দেশ হতে,এসেছ ঘুরে ফিরে, বাংলার বনে বেতে।" ষড়ঋতুর আবর্তনে এই গানের মতোই একরাশ রহস্যনিয়ে যেনো হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলার প্রকৃতিকে কিচিরমিচির শব্দ আর সৌন্দর্য্যে রাঙাতে ছুটে আসছে অতিথি পাখি নামের একদল আগুন্তুক।

 

প্রতিবছরই "শীতের আগমনে অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত হয় এই প্রকৃতি"। অতিথি পাখির সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করে বাংলার মানুষকে। পাখির কলকাকলিতে প্রকৃতি যেনো পায় ভিন্ন এক মাত্রা। শীত এলেই রং বেরঙের নাম না জানা এসব পাখিতে ভরে উঠে আমাদের হাওর বিল, পুকুর জলাশয় গুলো। নাম না জানা এইসব পাখি বিশেষ এই সময়ে অতিথি হয়ে আগুন্তক বেশে আমাদের দেশে ধরা দেয় বলে আমরা আদর করেই একে অতিথি পাখি বলে ডাকি।

এসব অতিথি পাখি যেনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করে। এসব অতিথি পাখি ছাড়াও বিচিত্র অনেক পাখির দেখা মিলে দেশজুড়ে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চালিকাশক্তি কর্ণফুলীর তীরে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা মিলে গাঙচিলের।এই গাঙচিল যেনো বিশেষ অতিথি কর্ণফুলীর। দেশ জুড়ে অতিথি পাখির মধ্যে দেখা যায় খন্জনা,পাতারি, জলপিপি,গিরিয়া,চখাচখি, রাঙামুড়ি হাঁস,নীলশীর পিয়াং, কাঁদা খোঁচা ইত্যাদি

 

অত্যন্ত শীত প্রধান দেশ যেমন সাইবেরিয়া কিংবা উওর বা মধ্য তিব্বত থেকে হাজার হাজার পথ পাড়ি দিয়ে ডানায় ভর করে উড়ে আসে এই পাখিগুলো। শীতের তিন চারমাস আমাদের এই দেশে সময় কাটিয়ে আবার নিজে দেশে ফিরে যায় এই পাখিগুলো। মূলত বিভিন্ন প্রজাতির ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে এই পাখিগুলো। নিজেদের খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন বনাঞ্চলকে বেঁছে নেয় এই পাখিগুলো। আর খাদ্য হিসেবে মাছ শিকারের জন্য এইসব পাখিগুলোকে ভীড় জমাতে দেখা যায় বিভিন্ন জলাশয়ের ধারে। আমাদের দেশীয় পাখির তুলনায় ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন হয়ে থাকে এই অতিথি পাখিগুলোর। বাচ্চা পালন, আশ্রয়ের জন্য বাসা নির্মাণ কিংবা শিকারের কৌশল সবক্ষেত্রেই দেখা যায় এই বৈচিত্র্য। মূলত শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে ঝড় বৃষ্টি ও প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজের বাঁচাতে এদেশে ছুটে আসে এই অতিথি পাখিগুলো। পাখিগুলো হিমালয়ের উঁচু শৃঙ্গগুলোকে পাশ কাটিয়ে পর্বতশ্রেণির ফাঁক দিয়ে, বেশ কিছুটা নিচু দিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়ে এদেশে এসে পৌঁছায়। 

 

 সাধারণত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস থেকে দলবেঁধে এই অতিথি পাখি এদেশে আসা শুরু করে। মার্চ ও এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রকৃতিকে কলকাকলিতে মাতিয়ে রাখে এইসব পাখি গুলো।

 

এই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এইসব অতিথি পাখির দেখা মেলে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে নীলফামারী জেলার নীলসাগরে প্রতি শীতে অতিথি পাখির ঝাঁক দেখা যায়।পাবনা জেলার চলন বিল এলাকা, সিরাজগঞ্জ জেলার হুরা বিল,নাটোর জেলা, পঞ্চগড় জেলার ভিতগড়, নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা হাওর , কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত হাওর নিকলি হাওর , নোয়াখালী জেলার নিঝুম দ্বীপ,হাতিয়া দ্বীপ যেনো হয়ে উঠে অতিথি পাখির মিলনমেলা।এছাড়া সিলেট জেলার হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিল, হাইল হাওরে পাখিরা আসে এবং সেখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর অতিথি পাখির জন্যও বেশ পরিচিত । ভোলা জেলার মনপুর দ্বীপ বরিশালের দুর্গাসাগরেও অতিথি পাখি সমাগমের বেশ সুনাম রয়েছে।

 

চট্টগ্রাম জেলার হাতিয়া দ্বীপ ,উড়ির চর, চরণদ্বীপ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী,সোনাদিয়া যেনো অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হয়ে উঠে। অনোয়ারা, কর্ণফুলীর তীরেও দেখা মিলে বহু অতিথি পাখির সমাগম। 

 

কর্ণফুলীর গাঙচিল যেনো বিশেষ অতিথি:

 

 কর্ণফুলীর সৌন্দর্য্যকে আরো বেশি মনোমুগ্ধকর করে তুলে গাঙচিলের দল। নদী ব্যবহারকারী ও পর্যটকদের জন্য নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করে। মূলত সাগর থেকে মাছ ধরার নৌকা গুলো নদীর তীরে ভিড়লে এই গাঙচিল নৌকা গুলোর পেছনে পেছনে উড়তে উড়তে নদীর তীরে চলে আসে। মূলত খাদ্য হিসেবে নদীর ছোট মাছ স্বীকার করে থাকে এই গাঙচিলের দল। গাঙচিলের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো চারপাশের প্রকৃতি। 

এই গাঙচিল সাধারণ মাঝারি থেকে বড় আকারের পাখি। এদের গাঁয়ের রঙ ধূসর বা সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। কখনও মাথা ও পাখায় কালো ছোপযুক্ত। তাদের লম্বা ডানা, যা দীর্ঘ সময় উড়তে সহায়তা করে। এদের প্রধান খাবার মাছ হলেও এরা পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এছাড়া গাঙচিলের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, এবং তাদের অধিকাংশই পরিযায়ী পাখি। এরা সাধারণত পাথরের খাঁজে শুকনো শেওলা দিয়ে বাসা তৈরি করে। বাংলাদেশে গাঙচিলের উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় এদের দেখা মেলে । এজন্যই বোধহয় গাঙচিল কর্ণফুলীর বিশেষ অতিথি।

 

এছাড়া আমাদের রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু স্থানেও এই অতিথি পাখির সমাগমে মুখর হয়ে উঠে আশে পাশের পরিবেশ।যার মধ্যে ঢাকার মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট লেক, চিড়িয়াখানা লেক, পিলখানা ইত্যাদি এলাকা ঢাকার মধ্যে হওয়ায় শহরের পাখিপ্রেমীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া ঢাকা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশ জনপ্রিয় এই অতিথি পাখির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়টির লেকগুলো তে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ প্রজাতির অতিথি পাখির দেখা মেলে।