প্রীতম সরকার, চট্টগ্রাম
কথায় আছে ভাদ্র মাসে শীতের জন্ম। লোকমুখে প্রচলিত এই কথা কম বেশি আমরা সবাই শুনেছি। আক্ষরিক অর্থে এই শীতের জন্ম ভাদ্র মাসে হলেও পৌষ আর মাঘ মাস এলেই যেনো আমরা শীতের অস্তিত্ব টের পাই। দরজায় কড়া নারে শীত। আর এই শীতের মৌসুম এলেই পড়ে পিঠা খাওয়ার ধূম। গ্রাম-বাংলা থেকে শুরু করে ইট পাথরের শহরগুলোতেও পিঠা যেনো চাই'ই চাই!
বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে জুড়ে থাকা যদি কোনো খাবারের কথা বলা হয় তবে পিঠা যেনো এক কাঠি উপরে। পুরো বাংলায় সর্বত্রই বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করা পিঠা যেনো শীতের আগমনকে জানায় উষ্ণ অভ্যর্থনা।
শীতের আগমন ঘটতেই বেশ কিছু বছর ধরে চোখে পড়ে শহরের রাস্তাগুলোতে বিভিন্ন ধরণের পিঠার পসরা নিয়ে বসেছে পিঠা বিক্রেতারা। গাড়িতে কিংবা রাস্তায় ভাসমান স্টলে বিক্রি করছে পিঠা। গরম গরম পিঠা ভেঁজে শীতের সন্ধ্যায় পিঠাপ্রেমীদের যেনো পিঠার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করার কোনো অভিযোগই রাখছেন না এই পিঠা বিক্রেতারা।
বিকাল কিংবা সন্ধ্যায় বের হলেই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ভাসমান স্টল কিংবা রাস্তায় তৈরি হচ্ছে গরম গরম ভাপা পিঠা। পিঠার গন্ধ আশ-পাশের মানুষ কে যেনো ডাকছে, আর বলছে এর স্বাদ আস্বাদন করতে না পারলে বিশাল কিছু মিস।
ভাপা পিঠার পাশাপাশি এই যান্ত্রিক শহরে আরেক জনপ্রিয় পিঠার নাম ‘চিতই’। চিতই পিঠার পসরা দেখে যে পিঠা খায় না তার মনেও যেন তৈরি হয় একবার স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছা। এক পাশে গরম গরম চিতই পিঠা, সাথে থাকে হরেক পদের ভর্তা। শুঁটকি ভর্তা, কাঁচা মরিচ ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা কি নেই!
রাস্তার পাশে ছোট ছোট এইসব ভ্রাম্যমাণ পিঠার দেখা মেলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নিউমার্কেট, আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, কাজির দেউরি, বড়পুল, অলংকার, সাগরিকা, সি-আরবি, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তা ও ফুটপাত গুলোতে। দোকানের পাশে জ্বলছে চুলা। একটি ভাপা পিঠা তৈরির পাতিল, অন্যটি চিতই পিঠার। পিঠা তৈরি হচ্ছে চালের গুঁড়ি, গুড় ও নারিকেল দিয়ে। তৈরি হতেই গরম গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠা নিমিষেই হয়ে যাচ্ছে শেষ।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্ধ্যার পরেই পিঠাপ্রেমীদের ভিড় জমে দোকানগুলোতে। বন্ধুদের মধ্যে খুঁনসুটি আর আড্ডায় পরিণত হয় সড়কের মোড়গুলো। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে শীতের পিঠা খেতে ব্যস্ত অনেকেই। প্রতিটি পিঠার মূল্য দশ টাকা থেকে শুরু করে পিঠার ধরণ অনুযায়ী তা কম-বেশি হতে পারে।
নগরীর কাজির দেউড়ি মোড়ে অফিস শেষে পিঠা খেতে আসা তৌহিদ আহম্মেদ বলেন, পিঠার কথা শুনলেই আগে গ্রামে যাওয়ার কথা মাথায় আসতো। গ্রামে না গেলে পিঠার সেই স্বাদ কিংবা গরম গরম পিঠার খাওয়ার আমেজ, পরিবেশ এই শহরে কতটুকু পাবো তা নিয়ে আফসোস হতো। তবে ইদানিং শহরের বিভিন্ন এলাকায় এই ভাসমান পিঠার দোকানগুলো থাকায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় গরম গরম পিঠা খাওয়ার যেমন সুযোগ হচ্ছে ঠিক তেমনি আড্ডাও হচ্ছে।
এদিকে নগরীর জামালখান এলাকায় ভাপা পিঠা খেতে আসা মিঠু নামের এক পিঠাপ্রেমীও জানান, শীতের সন্ধ্যায় গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। যা ছোটবেলার গ্রামের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
এই পিঠা বিক্রির জনপ্রিয়তা শহরের রাস্তা গুলোতে দিন দিন এতোই বাড়ছে যে অনেকেই শীত মৌসুম এলেই এই পিঠা বিক্রির ব্যবসায় নামতে আগ্রহী হচ্ছে।
চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় মো. জাহাঙ্গীর নামে এক পিঠা বিক্রেতা বলেন, কিছুদিন আগেও গরমে সরবত বিক্রি করতাম, কিন্তু শীতে পিঠার ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে পিঠা বিক্রিতে আগ্রহী হই। এখন পিঠা বিক্রি করি। পিঠাপ্রেমীরা পিঠার টানে বারবার আসে।
সাধারণত কৃষকের ধান কাটা শেষ হলে ও নতুন ধান ঘরে তোলার মৌসুম এলেই গ্রাম-বাংলায় পিঠার আগমন ঘটে। মূলত শীত ও পৌষ পার্বণের সময় প্রতিটি ঘরে ঘরে এই পিঠা যেনো নাস্তার প্রধান উপাদান। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে গরম গরম ধোঁয়া উঠা পিঠা খাওয়ার অনুভূতি সে সময় যে খায় সেই বলতে পারে।
এই লোভনীয় সুস্বাদু পিঠার মধ্যে, পাটি-সাপটা, ভাপা পিঠা, দুধ-পুলি, মালপোয়া, ক্ষীর-পুলি, দুধরাজ এসব প্রত্যেকটি পিঠাই কম বেশি মিষ্টি হয়ে থাকে।
নকশি পিঠা, গোলাপ পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা এগুলো ভুললে কি চলবে? একেক পিঠার স্বাদ ঠিক যেমন ভিন্ন মুখে দিতেই যেনো অনুভূতি ও ভিন্ন। কোনোটি একদম বেশি মিষ্টি, কোনোটি আবার একটু কম। দুধপুলি কিংবা ক্ষীরপুলি এই পিঠা গুলোর অন্যতম আকর্ষণ এর উপাদান। এই পিঠা গুলো দুধ দিয়ে তৈরি হয়, পরে পুর হিসেবে ক্ষীর সংযুক্ত করা হয়। এই দুধের ক্ষীর পিঠার স্বাদ কে দেয় অন্য এক মাত্রা। এই ক্ষীরযুক্ত পিঠা যখন মুখে পড়ে পিঠা প্রেমীদের কাছে যেনো মনে হয় তারা অমৃত আস্বাদন করছে। পিঠার স্বাদ ও জনপ্রিয়তাই যেনো বলে দেয় পিঠা বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অংশ।