প্রীতম সরকার
সময় অসময়ে কারণে অকারণে রাস্তায় কিংবা গলির মোড়ে ফুচকা দেখলেই যেন জীভে জল চলে আসে যে কারোর। আসবেই নাই বা কেনো? এই সুস্বাদু খাবার খেতে যেমন স্বাদ, টক দিয়ে ঝাল বাড়িয়ে ফুচকা মুখে দিতেই অনুভুত হয় এক স্বর্গীয় অনুভুতি। ঠিক তেমনি তার সহজলভ্যতা।
বন্ধুদের সাথে রিতিমতো প্রতিযোগিতা করে ঝাল বাড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার যে অলিখিত অলম্পিক তা তো বোধহয় চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের মধ্যকার ম্যাচের চেয়েও বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। স্কুলের টিফিন ছুটি কিংবা ক্লাস শেষে এই মুখরোচক খাবারটি না খেয়ে বাড়ি ফেরা যেনো রীতিমতো অন্যায় ফুচকা প্রেমীদের কাছে।
"ঝাল বাড়াই এক প্লেট ফুচকা দেন মামা"- এই একটা লাইনের মাঝে যে ফুচকা প্রেমীদের কত আবেগ লুকিয়ে আছে তা ফুচকাপ্রেমীর মুখ থেকে না শুনলে হয়তো বোঝা যাবে না। যতই ঝাল লাগুক কিংবা চোখ দিয়ে পানি পড়ুক তবুও যেনো আটকানো যায় না ফুচকাপ্রেমীদের ফুচকা খাওয়া থেকে। একদিন খেলে কিছু হবে না এটাই যেনো ফুচকা প্রেমীদের চিরাচরিত সংলাপ। এই ফুচকা যেনো তাদের চাই ই চাই!
ফুচকার ইতিহাস জানতে গেলে উঠে আসে বিভিন্ন ঘটনা। এছাড়া সময়ের সাথে সাথেও ফুচকার ধরণেরও হয়েছে বেশ পরিবর্তন। ইতিহাস ঘাটলে ইন্ডিকা বইয়ের লেখায় দেখা যায়, আজ থেকে ২ হাজার ৩৩৩ বছর আগে ফুচকার জন্ম বা প্রথম দেখা। মহাভারতের কাহিনীর সাথেও রয়েছে এই ফুচকার সম্পর্ক। সেই সময় পঞ্চ-পান্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে রান্নার ভার দিলে, রান্নার জন্য পর্যাপ্ত উপকরণ না থাকায় শুধু ময়দা আর আর বাসী আলু দিয়ে তেলে ভেজে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে। যেটি মূলত ফুচকার আদিরুপ। আবার কোথাও লেখা আছে এই ফুচকার জন্ম ভারতের মগধ রাজ্যে ৬শ’ খ্রিস্টাব্দে যা বর্তমানে পশ্চিম মধ্য বিহার নামে পরিচিত।
তবে সে সময়ের আদিরুপ ফুলকি থেকে এই সময়ের ফুচকায় এসেছে বেশ ভিন্নতা। ভিন্নতা শুধু ফুচকা তৈরিতেই নয় বরং স্বাদ ও ধরণেও। সাধারণ রাস্তায় কিংবা গলির মোড়ে যে চিরাচরিত ফুচকা পাওয়া যেতো সেই টক ফুচকার পাশাপাশি এখন পাওয়া যায় দই ফুচকা, বোম্বাই ফুচকা, চকলেট ফুচকা, নাম না জানা আরো কত কি! অঞ্চল ভেদে আবার এই ফুচকার বহু নাম। কারো কাছে পানিপুরি, কারো কাছে গোলগাপ্পা আবার কারো কাছে পাতাশি। আমাদের দেশে ফুচকা, এই ফুচকাই আবার মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটে পানিপুরি। আর ফুচকার সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ টক জল। তেঁতুলের টক জল ছাড়াও জায়গা ভেদে চাটনি, মরিচের ভর্তাও ব্যবহৃত হয়।
প্রতিটি ফুচকার উপকরণে কিছুটা তারতম্য ও ভিন্নতা থাকলেও সব গুলোই জীভে জল আনা বেশ মুখোরোচক। সাধারণ যে ফুচকা আমরা রাস্তায় বের হলেই দেখি কিংবা খাই সেই ফুচকা বানানোর রেসিপির দিকে যদি চোখ দেই তবে দেখতে পাই- আটা বা সুজির ময়রা নকুল দানার আকৃতির মতো লেচি কেটে তা বেলনির সহযোগে তেলে ভেজে তৈরি করা হয়। আর ভেতরে পুর হিসেবে মশলাযুক্ত আলু সেদ্ধ, মটর, কাঁচা মরিচ থাকে। টক জল হিসেবে থাকে তেতুল জল, কখনো বা পুদিনামিশ্রিত পানি। ফুচকার ভেতরে পুর আর টক জল দিয়ে ডুবিয়ে মুখে দিলেই যেকোনো ফুচকাপ্রেমী যেনো নিমিষেই স্বাদের রাজ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে।
বর্তমানে এই ফুচকা এতোটাই জনপ্রিয় যে রীতিমতো অনেক রেস্টুরেন্টে এর দেখা মিলে। ইদানিং অনেক বিয়ে বাড়িতে স্টল দিয়ে বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি ফুচকাও বিশেষ নজরে আসে।
মুখরোচক ফুচকা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত
বাসায় ফুচকা বানানো গেলেও ফুচকা প্রেমীদের প্রধান আকর্ষণ থাকে রাস্তার ফুচকা কিংবা গলির ফুচকা দোকানে। ফুচকা খেতে যতটা স্বাদ ও মুখরোচক বাস্তবে যদি দেখা যায় তবে রাস্তার ফুচকার দোকান গুলো মোটেও স্বাস্থ্য সম্মত কিংবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে বানানো হয় না। ফুচকা বানানোর যে স্থান অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেটি অপরিষ্কার, কখনো দেখা যায় ফুচকা তৈরির উপকরণ গুলোর উপর মাছি ঘুরছে কখনো বা দেখা যায় ফুচকা তৈরির প্রধান উপাদান ময়দার ময়ানে যে পানি ব্যবহৃত হচ্ছে তা অপরিষ্কার ও ব্যবহারের অনুপযোগী। ফুচকার অপরিহার্য উপাদান যে উপাদান ছাড়া ফুচকা ফুচকাই না বললে চলে সে টক ও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ময়লা পানি দিয়ে তৈরি করা হয়।
এছাড়া ফুচকা বানানোর যে কারিগর ও বিক্রেতা উভয়ই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিষ্কার পোশাক পরিধান ও হাত না ধোয়ার বিষয়টি চোখে পড়ে। আর এই ফুচকাপ্রেমীদের বড় একটা অংশ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরিকৃত এই ফুচকা খেলে শিক্ষার্থীদের প্রায় স্বাস্থ্যঝুকিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পেট খারাপ কিংবা ডায়রিয়ার মতো অসুখ জেঁকে বসে। তাই ফুচকা বিক্রেতা কিংবা ফুচকার কারিগর উভয় সর্তকতার সাথে যত্ন নিয়ে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ফুচকা বিক্রি করলে বাঙালির এই আবেগ জীভে জল আনা ফুচকা, ফুচকাপ্রেমীদের ফুচকার জগতে এর স্বাদ গ্রহণে যেমন অক্ষুন্ন রাখবে ঠিক তেমনি দূর হবে স্বাস্থ্যঝুঁকি।